ঢাকার কলেজগুলো কেন সংঘর্ষে জড়ায়?

সম্প্রতি রাজধানীতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা যে কা- ঘটাল, তা বিস্ময়কর। ঘটনার সূত্রপাত ‘ভুল চিকিৎসায়’ একজন ছাত্রের মৃত্যু। এই অভিযোগে ২৪ অক্টোবর দুপুরের দিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে হামলা চালায় পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। এ সময় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পাশের সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর রেশ ধরে সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। প্রতিবাদে পরদিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালানো হয়। তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ডেমরা এলাকা। এর আগের দিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি (বুটেক্স) এবং সংলগ্ন পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়।

রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই অন্তর্কোন্দল বা আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘর্ষ এখন মোটামুটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ এবং এর কাছেই সেন্ট্রাল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। এর নেপথ্যে একাধিক কারণ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মারামারির সূত্রপাত হয় প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে। সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়। 

তবে এবারের সংঘর্ষটি অতীতের চেয়ে ভিন্ন। কেননা এর আগের সংঘর্ষগুলো মূলত দুটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০ নভেম্বরের সংঘর্ষ চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঢাকা কলেজের স্থাপনায় ‘সরাসরি হামলা ও ভাঙচুর’ চালিয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। হামলার ‘নির্দেশদাতা’ পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘ক্ষমা চেয়ে’ পদত্যাগের দাবি করেছে ঢাকা কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সংঘর্ষ এড়াতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা থেকে সিটি কলেজ সরিয়ে নেওয়ারও দাবি তুলেছে তারা। তাদের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা কলেজের সাত শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। সে কারণে পরিকল্পিতভাবে ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হামলা করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে সরাসরি সিটি কলেজ ও পুলিশ জড়িত ছিল।

নেপথ্যে প্রেম?

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাশের সিটি এবং অদূরেই আইডিয়াল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের অন্যতম একটি কারণ প্রেম। ঢাকা কলেজে যেহেতু ছাত্রী নেই, তাই তারা সিটি ও আইডিয়াল কলেজের ছাত্রীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বা সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হলে অথবা ঢাকা কলেজের কোনো ছাত্র এসে সিটি বা আইডিয়ালে প্রেম করছে এবং ঢাকা কলেজের সেই ছাত্র সিটি বা আইডিয়ালের কোনো ছাত্রের সঙ্গে এ নিয়ে তর্কে জড়িয়েছে মানেই সেটির পরিণতি হাতাহাতি। আর ঢাকা কলেজের কোনো ছাত্র যখন মার খেয়ে ক্যাম্পাসে যায় তখন সেখান থেকে তার বন্ধু ও সহপাঠীরা দল বেঁধে সিটি বা আইডিয়ালে গিয়ে মারধর, ভাঙচুর চালায়। এসব ঘটনা বেশি ঘটে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী তথা টিনএজদের মধ্যে। কিন্তু ছোটদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে পরে বড়রাও তথা অনার্স মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরাও এতে জড়িয়ে পড়েন নিজ নিজ কলেজের ‘ভাবমূর্তি রক্ষা’ তথা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য।

ছাত্ররাজনীতি ও অন্যান্য

সব কলেজেই কমবেশি ছাত্ররাজনীতি আছে। অনেক সময় রাজনৈতিক বিভেদও আন্তঃকলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের নেপথ্যে ভূমিকা রাখে। যেহেতু কলেজ দুটি পাশাপাশি অবস্থিত, ফলে ফুটপাতে চলাফেরা, বাসে ওঠানামার মতো সামান্য ঘটনায়ও এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, যার পেছনে থাকে ইগো এবং আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা। 

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়। ওই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ মারামারি এবং সংঘর্ষকে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে দেখে। এ ছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষার্থীরা প্রায়ই কলেজ ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় নানা ইস্যুতে জড়ো হয় এবং তাতেও অনেক সময় ছোটখাটো সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ঢাকা কলেজ সংলগ্ন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া কোনো কোনো বিষয়ও অনেক সময় উত্তেজনা ছড়ায়, যা শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ উসকে দেয়।

সমাধান কী?

এই ধরনের সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে রকম যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন, তা দেখা যায় না। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, অথচ এর স্থায়ী সমাধানে আন্তঃকলেজ কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

অনেকে রসিকতা করে বলে থাকে ঢাকা কলেজে ছাত্রী ভর্তি শুরু হলে সংকট অনেকখানি কেটে যাবে। এটি শতভাগ ছাত্রের ক্ষেত্রে সত্য না হলেও এর যে একটি মনস্তত্ত্ব রয়েছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না।

প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার সুরাহা হয় না কেন? সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের তাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর কি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? শিক্ষা প্রশাসন কী করছে এবং এর স্থায়ী সমাধানই বা কী?

যেকোনো কারণে দুটি কলেজের শিক্ষার্থী কিংবা একই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিবাদ তৈরি হতে পারে। মনোমালিন্য হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে বা সহিংসতা শুরু করে দেবে? একটি কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে চলে যেতে হবে, এটি কোনো শিক্ষিত মানুষের আচরণ নয়। ঢাকা কলেজের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে এই দৃশ্য আমাকেও লজ্জিত করেছে।

আবার মারামারি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে সিটি কলেজ সরিয়ে নিতে হবে, এটিও কোনো যৌক্তিক দাবি নয়। বরং কীভাবে পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি কলেজের শিক্ষার্থী পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা নিয়ে বসবাস করতে পারে, পড়াশোনা করতে পারে, সেই পথ খুঁজে বের করাই শিক্ষকদের, শিক্ষা প্রশাসনের কাজ। এটি ক্ষমতা বা আধিপত্য প্রদর্শনের বিষয় নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষাটাই দিতে না পারে, তাহলে সেটিকে আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বলার অবকাশ কোথায়?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh