বেশি কঠোর হলে সাকিব আবার কোথায় আঘাত করে বসেন

সাকিবের লাথি ও শাস্তি হিসেবে তিন ম্যাচের জন্য তার সাসপেন্ড হওয়া এখন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা তুঘলকি ঘটনাপ্রবাহকে সামনে নিয়ে এসেছে। ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কেন আলোচনা নেই সেই প্রশ্নের উত্তর যাদের দেয়ার কথা তারা বরাবরই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। কিন্তু চলমান বিতর্কে মুখ খুলেছেন অন্য অনেকেই।

মাঠে যারা ক্রিকেটের আইন প্রয়োগ করবেন, ক্রিকেটের চেতনা যাদের ছায়ায় টিকে থাকবে, তারা আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারি। কিন্তু এটা এখন প্রায় সবার জানা যে, মাঠে ক্ষমতাসীন ক্লাবগুলোর নগ্ন প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারিরা অনেক আগেই সেই মর্যাদার আসন হারিয়েছেন।

গত কয়েক বছরে ঢাকার ক্রিকেটের এ রকম ঘটনার অভাব নেই। আউট না হলেও ব্যাটসম্যানকে আউট দেয়া, আবার আউট হলেও আউট না দেয়া, ওয়াইড-নো নিয়ে গড়বড় তো আছেই। 

২০১৭ সালে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিনব এক প্রতিবাদ করে ১০ বছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছিলেন লালমাটিয়া ক্লাবের ক্রিকেটার সুজন মাহমুদ। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এক্সিওম ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ম্যাচে সেদিন ইচ্ছা করে ওয়াইড বল করে এক ওভারে ৯২ রান দিয়েছিলেন সুজন।

একের পর এক বাজে আম্পায়ারিংয়ের ঘটনা ও ভুক্তভোগী ক্লাবগুলোর লিখিত অভিযোগের পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আজ পর্যন্ত কোনো আম্পায়ারের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে বা কাউকে শাস্তি দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। বরং মাঠে বিশেষ বিশেষ ক্লাবকে অন্যায় সুবিধা দিয়ে সেই আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারিরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি সুবিধাভোগীই হয়েছেন। আর তাদের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তে অন্যায়ভাবে ম্যাচ জিতে প্রভাবশালী ক্লাবগুলো পয়েন্ট তালিকায় থাকছে ওপরের দিকে। নিশ্চিত করছে বিসিবির নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান।

২০১৯ সালের একটি ঘটনা। ফতুল্লা স্টেডিয়ামে তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে কামরাঙ্গীরচরের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে হট্টগোল বাধাল ঢাকা রয়্যালস। পরে অধিনায়কের রিপোর্টে ঢাকা রয়্যালস অধিনায়ক শাহরিয়ার অনিক আম্পায়ারকে ‘চোর’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ওই ঘটনার ৮-১০ দিন পর শাহরিয়ার ও কোচ সাইফুল ইসলামকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করে বিসিবি, যে শাস্তি এখনো বহাল। অভিযোগ আছে, তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছিল যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই।

ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব ঘটনা যে শুধু পয়েন্ট তালিকাটাকেই প্রভাবশালীদের মনের মতো করে সাজিয়ে দিচ্ছে, তা নয়। এর সবচেয়ে বিষাক্ত প্রভাব পড়ছে নবীন ক্রিকেটারদের ওপর। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, পেশিশক্তি প্রদর্শন ও ক্লাব রাজনীতি তাদের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার আবহাওয়াকে দূষিত করে তুলেছে। ভুলকেই ‘ঠিক’ জেনে বেড়ে উঠছে তরুণদের ক্রিকেটার সত্তা। খেলতে নামার আগেই তারা জানেন আজ হারতে হবে, অথবা তাদের জয় ঠেকাতে পারবে না কেউ।

ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে পাওয়া এই ‘শিক্ষা’র কারণেই তৃতীয় বিভাগের একটি দলের তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে ‘হাসির পাত্র’ হয়ে পড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে ম্যাচে আম্পায়ার ‘নো’ বল না দেয়ায় ক্ষুব্ধ সাকিব হাতের ইশারায় মাহমুদউল্লাহ ও রুবেল হোসেনকে মাঠ ছেড়ে উঠে আসতে বলেছিলেন, সেই ম্যাচটি একসঙ্গে বসে দেখছিলেন ওই ক্রিকেটাররা। মাঠে সাকিবের ক্ষুব্ধ আচরণ দেখে তারা হেসে খুন। একজন তো বলেই ফেললেন, ‘এক-দুইটা নো বল না দেয়াতেই এত রাগ! সাকিব ভাইয়ের উচিত আমাদের থার্ড ডিভিশন ক্রিকেট খেলা। তাহলে যদি কিছু শিখত।’

খেলার মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে ক্ষমতাবানদের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। একটা সময় ছিল যখন আম্পায়ারদের মধ্যেই ক্লাব সমর্থক ছিল। আবার বিশেষ তারকার প্রতি অনুরাগ কিংবা ভীতি থেকেও পক্ষপাতের ঘটনা ছিল। কিন্তু মুশকিল হলো এখন একটি দুটি ম্যাচ নয় পুরো টুর্নামেন্টই এই রোগের জালে আটকা। ক্ষমতাবান দলের বিরুদ্ধে নিজেদের ম্যাচেই শুধু পক্ষপাত আদায় নয়, অন্য ম্যাচগুলোকেও প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগ আছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন সুনিপুণ পরিকল্পনায় ম্যাচ আম্পায়ার বণ্টনের মাধ্যমে ছক করা হয় ক্ষমতাবান ক্লাব বা ক্লাবগুলোকে জেতানোর! প্রশ্ন উঠতে পারে আম্পায়ারদের এখন যে বেতন কাঠামো আর যা ম্যাচ ফি তাতে পেশাদার আম্পায়াররা কেন এভাবে নৈতিকতা বিসর্জন দেবেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন উত্তরটা সহজ। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকরা অনায়াসেই তাদের টোপ দেন হয় নির্দেশ মানো, নয়তো বেতন ও ম্যাচ ফি বিসর্জন দাও। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ বিশেষ দলের ম্যাচে এখন সবচেয়ে আগে নজর পড়ে আম্পায়ারদের ওপর।

গত শুক্রবারের (১১ জুন) আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন ইমরান পারভেজ রিপন ও মাহফুজুর রহমান লিটু। অথচ দুই বড় দলের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই দুজনের চেয়েও দক্ষ একাধিক আম্পায়ার, যারা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, দেশে আছেন। তারা কেন দায়িত্ব পেলেন না? উত্তরটা অবশ্য আগে থেকেই জানা। ক্ষমতাবান দলের ম্যাচ পরিচালনায় অস্বস্তিবোধ করেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আম্পায়াররা। তাই প্রিমিয়ার লিগের সপ্তম রাউন্ড খেলা আবাহনীর চারটি ম্যাচে ইমরান পারভেজ ও তিনটি ম্যাচে মাহফুজুর রহমানকে দেখা গেছে। এর মধ্যে মোহামেডান ও গাজী গ্রুপের বিপক্ষে আবাহনীর ম্যাচ দুটি জুটি বেঁধে পরিচালনা করেছেন তারা। কিন্তু সব কিছুর আগে তো খেলা। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুল আম্পায়ারিং আসলে শুধু একজন ক্রিকেটারকেই নয় পুরো ক্রিকেটকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের এই চিত্র ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবারই জানা। কিন্তু ভয়েই হোক বা ভবিষ্যতে সুবিধা লাভের আশায়, এসব নিয়ে কথা কেউই বলে না। সিসিডিএমের প্রধান কাজী ইনাম আহমেদ তবু আশা দিলেন, ‘কোনো ক্লাব যদি এ রকম অভিযোগ আমাদের লিখিতভাবে জানায়, সিসিডিএম থেকে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে বোর্ডকেও অবহিত করব, যেন ভবিষ্যতে ক্রিকেটকে এসব সমস্যামুক্ত করা যায়।’

ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সদাচরণ আর অসদাচরণের শিক্ষা যেমন ঘরেই শুরু হয় তেমনি এ-কথাও সবাই মানবেন যে, ঘরোয়া ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নতি ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও উন্নতি সম্ভব নয়। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ঘরোয়া ক্রিকেটে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা শুধু একটা টুর্নামেন্টের পয়েন্ট তালিকাই প্রভাবশালীদের অনুকূলে সাজিয়ে দিচ্ছে না, এসবের বিষাক্ত প্রভাব পড়ছে নবীন ক্রিকেটারদের ওপর।

পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, পেশিশক্তি প্রদর্শন ও হীন ক্লাব রাজনীতি ভালো ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার আবহাওয়াকে দূষিত করে ফেলছে। খেলতে নামার আগেই যদি কেউ জানেন আজ হারতে হবে, অথবা আজ কেউ জয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, তাহলে খেলাই অর্থহীন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো ক্রিকেটার তৈরি করতে হলে আগে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে সত্যিকার ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই।

সাকিব আল হাসানের ‘বিখ্যাত’ হয়ে যাওয়া লাথিটা ক্রিকেটের চেতনাবিরোধী সন্দেহ নেই। তবে ক্লাব ক্রিকেটের দুষ্টু চক্রের দেয়ালে সেটা প্রচণ্ড এক আঘাতও। সেই আঘাতে ক্রিকেট প্রশাসন এতটাই টালমাটাল যে সাকিবকে ন্যূনতম শাস্তি দিয়েই দায় সেরেছে তারা। বেশি কঠোর হলে সাকিব আবার কোথায় আঘাত করে বসেন, কে জানে!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //