রঙিন চশমায় তারা আট

যে কোনো টুর্নামেন্টেই প্রথমবারের মতো খেলতে যাওয়াটা স্বপ্নময় একটা ব্যাপার। আর সেই টুর্নামেন্টটা যদি হয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ, তাহলে তো কথাই নেই। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ দলে ডাক পাওয়া ক্রিকেটারদের আনন্দের সীমা থাকে না। সবকিছুকেই রঙিন মনে হয়। রোমাঞ্চ-উত্তেজনায় মনটা উরু উরু করে। সেই উরু উরু মন নিয়েই রঙিন চশমা পরে আসন্ন ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে গেছেন বাংলাদেশের ৮ জন ক্রিকেটার।

ভারতের মাটির বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের দলের মাত্র ৭ জনের বিশ্বকাপ খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাকি ৮ জনই ভারতে গেছেন প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে। রঙিন স্বপ্নের চশমা পরে ভারতে যাওয়া সেই ৮ জন হলেন-নাজমুল হোসেন শান্ত, তানজিদ হাসান তামিম, তাওহিদ হৃদয়, নাসুম আহমেদ, শেখ মেহেদী হাসান, হাসান মাহমুদ, শরীফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এই নতুন ৮ জনের মধ্যে নাজমুল হোসেন শান্ত, মেহেদী হাসান, নাসুম আহমেদ ও হাসান মাহমুদ ২০২২ সালের ছেলেদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছেন। বাকি ৪ জন তানজিদ হাসান তামিম, তাওহিদ হৃদয়, শরীফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব-এরা বড়দের বিশ্বকাপে এবারই প্রথম। তবে এই ৪ জনেরও কিন্তু বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। রয়েছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার রঙিন অভিজ্ঞতাও। তবে সেটা ছোটদের বিশ্বকাপ। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। ফাইনালে মহাশক্তিধর ভারতকে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের যুবরাদের সেই ঐতিহাসিক শিরোপা সাফল্যে বড় অবদান রেখেছিলেন উল্লেখিত ৪ তরুণ তুর্কি।

কিন্তু ছোটদের বিশ্বকাপ আর বড়দের বিশ্বকাপ এক নয়। এক নয় টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে বিশ্বকাপও। ক্রিকেটে অনেক অনেক বিশ্বকাপের উদয় ঘটলেও এখনো ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ছেলেদের ওয়ানডে বিশ্বকাপই আসল বিশ্বকাপ। ক্রিকেটারদের কাছেও, যা মূলত ক্রিকেট বিশ্বকাপ নামেই পরিচিত। প্রতিটা ক্রিকেটারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হলো এই ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলা। নাজমুল, তানজিদ, তাওহিদ, শরীফুল, তানজিম, নাসুম, শেখ মেহেদী, হাসান মাহমুদরা এখন সেই স্বপ্ন হাতের মুঠোয় নিয়ে অপেক্ষায় আছেন মাঠে নামার। প্রহর গুনছেন বিশ্বকাপ অভিষেকের। কল্পনার তুলিতে মনের আয়নায় আঁকছেন বিশ্বকাপ রাঙানোর স্বপ্ন। এদের অধিকাংশের এই স্বপ্নও পূরণ হয়ে যাবে আগামী ৭ অক্টোবর। সেদিনই যে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ, ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে।

প্রবীণকে সরিয়ে নবীনের আসনগ্রহণ-সৃষ্টিকর্তার চিরন্তন এই নিয়মের পথেই বাংলাদেশ জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন এই তরুণরা। বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার আগে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেনও এদের সবাই। তবে এই ৮ জনের মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে এগিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে তার। সেই থেক এ পর্যন্ত খেলেছেন ২৩টি টেস্ট, ৩০টি ওয়ানডে ও ২৫টি টি-টোয়েন্টি। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। রয়েছেন দুর্দান্ত ফর্মেও। 

৩০ ওয়ানডেতে ৯০৮ রান করা নাজুমল দুটি সেঞ্চুরি ও ৫টি হাফসেঞ্চুরিও করেছেন। ওয়ানডেতে দুটি সেঞ্চুরিই তিনি করেছেন এ বছর। প্রথমটি (১১৭) গত ৯ মে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে, ইংল্যান্ডের চেমসফোর্ডে। দ্বিতীয়টি (১০৪) গত ৩ সেপ্টেম্বর এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ওই ম্যাচেই চোট পেয়ে এশিয়া কাপ শেষ হয়ে যায় তার। নাজমুল সেই চোট থেকে ফেরেন দলের অধিনায়ক হয়ে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত হোম সিরিজের শেষ ম্যাচে। সেই ম্যাচেও নাজমুল খেলেছেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৩ রানের ইনিংস। ব্যাটিংয়ে এই ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার পাশাপাশি নাজমুল আরো একটি পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সহঅধিনায়ক ২৫ বছর বয়সি নাজমুল। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দেবেন তিনিই।

ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতায় এর পরই আছেন পেসার শরীফুল ইসলাম। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার ২২ বছর বয়সি বাঁ-হাতি এই পেসার এ পর্যন্ত খেলেছেন ৭টি টেস্ট, ২২টি ওয়ানডে ও ৩১টি টি-টোয়েন্টি। তাতে উজ্জীবিত পারফরম্যান্সের সুবাদে দলে জায়গাটাও এক রকম পাকা করে ফেলেছেন। ৭ টেস্টে নিয়েছেন ৭ উইকেট, ২২ ওয়ানডেতে ৩৫টি ও ৩১ টি-টোয়েন্টিতে ৩৪ উইকেট শিকার করেছেন। ওয়ানডেতে এরই মধ্যে তিন বার ৪ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এবার পালা বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর।

২৩ বছর বয়সী হাসান মাহমুদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা ২০২০ সালের ১১ মার্চ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি ওয়ানডে ও ১৭টি টি-টোয়েন্টি খেলে তিনিও জাতীয় দলে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। ১৮টি ওয়ানডে খেলে নিয়েছেন ২৫ উইকেট। এর মধ্যে এক ম্যাচে ৫ উইকেট কীর্তিও আছে তার। ২৩ মার্চ সিলেটে আয়ারল্যান্ডকে ১০১ রানে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পথে হাসান মাহমুদ ৩২ রান খরচায় তুলে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তির জায়গা পেস বোলিং আক্রমণ। তাতে শরীফুল, হাসান মাহমুদও বড় ভূমিকা রাখছেন।

ম্যাচ অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে এর পরের নামটি তাওহিদ হৃদয়ের। ২২ বছর বয়সী ডানহাতি এই তরুণ ব্যাটসম্যানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু এ বছরই, ৯ মার্চ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। ওয়ানডে অভিষেক ১৮ মার্চ, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেই। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১৭টি ওয়ানডে ও ৮টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। সেঞ্চুরির দেখা না পেলেও ওয়ানডেতে ৫টি হাফসেঞ্চুরি রয়েছে তার। গত ১৮ মার্চ ওয়ানডে অভিষেকেই ৯২ রানের ইনিংস খেলে দলকে দারুণ জয় উপহার দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচসেরার পুরষ্কারটিও জিতে নেন তিনি। পাশাপাশি জানিয়ে দেন নিজের আগমনী বার্তাও। তাওহিদ হৃদয় প্রয়োজনে হাত ঘুরাতেও জানেন। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো বোলিং করার সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে ঘরোয় ক্রিকেটে কখনো-সখনো নিজের অফ-স্পিন দক্ষতাটা দেখিয়ে থাকেন। সাকিব এবং মেহেদী হাসান মিরাজের মতো পরীক্ষিত দুই স্পিনার থাকার পরও অন্য স্পিনারদের জন্য দলে জায়গা করে নেওয়াটা কঠিনই। বিশেষ করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলে। সেই কঠিন কাজটাই করে চলেছেন বাঁ-হাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ ও ডান হাতি অফস্পিনার শেখ মেহেদী হাসান। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর ২৮ বছর বয়সি নাসুমের। এরই মধ্যে ১২টি ওয়ানডে ও ৩৫টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ১২ ওয়ানডেতে ১২ উইকেট, ৩৫ টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ৩৪ উইকেট। দলের প্রয়োজনে ব্যাটও ধরতে জানেন। বিশ্বকাপ যেহেতু স্পিন-স্বর্গ ভারতে, সে কথা মাথায় রেখেই হয়তো তাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নাসুমের এবার সুযোগটা কাজে লাগানোর পালা।

শেখ মেহেদী হাসানের টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ২০১৮ সালে। ওয়ানডেতে ২০২১ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৮টি ওয়ানডে ও ৩৮টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ৮ ওয়ানডেতে উইকেট নিয়েছেন ৮টি, ৩৮টি-টোয়েন্টিতে ৩০টি। বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেলে শেখ মেহেদী হাসান নিজেকে মেলে ধরবেন, সেই প্রতাশাই রইল। 

দলের বাকি দুই তরুণ তুর্কি, তানজিদ হাসান তামিম ও সানজিম হাসান সাকিব-দুজনেরই আন্তজার্তিক ক্রিকেটে অভিষেক গত এশিয়া কাপে। অভিজ্ঞ ওপেনার তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে সুযোগ পাওয়া ছোট তামিম এ পর্যন্ত খেলেছেন ৫টি ওয়ানডে। তার ৪ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেলেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকটা তার হয়েছে ‘ডাক’ মেরে। এরপর ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরে নিজেদের শেষ ম্যাচেও সুযোগ পেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। আউট হন ১৩ রান করে। বিশ্বকাপে তাকে দলে নিতেই হবে, সেই ভাবনা থেকেই হয়তো টিম ম্যানেজমেন্ট নিউজিল্যঅন্ডের বিপক্ষে সিরিজের তিন ম্যাচেই তাকে খেলিয়েছে। বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার কারণে প্রথম ম্যাচে ব্যাট করতে নামা হয়নি। পরের দুই ম্যাচে করেছেন ১৬ ও ৫ রান; কিন্তু কি আশ্চার্য, এমন ভয়ানক শুরুর পরও ঠিকই তিনি জায়গা পেয়েছেন বিশ্বকাপ দলে। শুধু জায়গা পাওয়া নয়, দলের অপরিহার্য ওপেনারের ভূমিকায় রয়েছেন তিনি! বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের বিশ্বকাপ দলে স্বীকৃত ওপেনারই মাত্র দুজন-তানজিদ হাসান তামিম ও লিটন কুমার দাস। ফলে বিশ্বকাপে তানজিদ হাসান তামিম ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন, এটা সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন হলো, শুরুর ব্যর্থতাকে আড়াল করে ভারত বিশ্বকাপে নিজেকে সত্যিকার ওপেনার হিসেবে মেলে ধরতে পারবেন তানজিদ হাসান তামিম? 

৮ নবাগতের সর্বশেষ জন সানজিম হাসান সাকিব এ পর্যন্ত খেলেছেন ২টি ওয়ানডে। এর মধ্যে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকেই ক্রিকেট দুনিয়ার নজর কেড়েছেন। গতি, সুইং দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন ক্রিকেটবোদ্ধাদের। গত ১৫ সেপ্টেম্বর, কলম্বোর সেই ম্যাচে বাংলাদেশকে জয় এনে দেওয়ার পথে ছোট সাকিব শুরুতেই ২ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে কাঁপিয়ে দেন। প্রথমে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে ‘ডাক’ উপহার দেন। পরে তিলক ভার্মাকে বিদায় করেন অবিশ্বাস্য সুইংয়ের জাদুতে। অফ-স্টাম্পের বাইরে পিচ করা বল বাইরে দিয়ে যাবে ভেবে খেলার কোনো রকম চেষ্টা না করে ছেড়ে দেন তিলক ভার্মা; কিন্তু পেছন দিকে তাকিয়ে দেখেন স্টাম্পের বেল নেই! শুধু তিলক ভার্মা নয়, তানজিম সাকিবের অবিশ্বাস্য ডেলিভারিটি ক্রিকেট দুনিয়াকেই তাক লাগিয়ে দেয়; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, ওই ম্যাচের পরই তার এক বছর আগের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সমালোচনায় মেতে উঠে একটা দল। সেই সমালোচনা মাথায় নিয়েই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচটি খেলতে নামেন ছোট সাকিব; কিন্তু বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ম্যাচটি বোলিং করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৫.৪ ওভার। পরের দুই ম্যাচে খেলাই হয়নি তার। তবে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকেই ক্রিকেট দুনিয়াকে নিজের জাতটা চিনিয়েছেন, সেই ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপটাও নিশ্চয় রাঙিয়ে নিতে চাইবেন তানজিম সাকিব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //