বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৪ জয়

বিশ্বকাপ (ওয়ানডে) এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা। খেলাটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) প্রতি চার বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করে থাকে। প্রাথমিক বাছাইপর্ব শেষে দলগুলো চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়। ১৯৭৫ সালের জুনে ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম তিনটি বিশ্বকাপ হয়েছে ইংল্যান্ডেই। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে একটি অনানুষ্ঠানিক ঘূর্ণন ব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আয়োজক নির্বাচন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আইসিসির চৌদ্দটি সদস্য দেশ এ প্রতিযোগিতার অন্তত একটি ম্যাচ আয়োজন করেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রথম ছয়টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অংশ গ্রহণ করার সুযোগ বা যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের সপ্তম আসরে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ছয়টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। ছয় আসরে মোট ৪০টি ম্যাচ খেলেছে, যার মধ্যে ১৪টি জয়ের বিপরীতে হেরেছে ২৫টিতে। একটিতে কোনো ফল হয়নি।

প্রথম জয়, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ
বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই প্রথম জয়ের স্বাদ পায় নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে। প্রথম দুই ম্যাচে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হারের পর তৃতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানের জয় তুলে নেয় আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দল। টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ ৯ উইকেটে গড়ে ১৮৫ রানের পুঁজি। জবাবে বাংলাদেশের বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে স্কটল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় ১৬৩ রানে। জয়ের পথটা মোটেই সহজ ছিল না। মাত্র ২৬ রানেই বাংলাদেশ পাঁচ উইকেট হারিয়ে চরম বিপদে পড়ে যায়। ষষ্ঠ উইকেটে সেই বিপর্যয় সামাল দেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এবং নাইমুর রহমান দুর্জয়। দুর্জয় ৫৮ বলে ৩৬ রান করে সাজঘরে ফিরলে আবার বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। এরপর লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যান নান্নু। তার দৃঢ়তায় ৫০ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ১৮৫ রান জমা করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। ১১৬ বলে ৬৮ রান করে অপরাজিত থাকেন নান্নু। এ ছাড়া এনামুল হক মণির ব্যাট থেকে আসে ১৯ রান। 

৮ রানেই স্কটল্যান্ডের তিন উইকেট তুলে নেন হাসিবুল হোসেন শান্ত এবং মঞ্জুরুল ইসলাম। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে গ্যাভন হ্যামিল্টনের ৬৩ রানের ইনিংসের পরও ২২ বল বাকি থাকতে অলআউট হয়ে যায় স্কটল্যান্ড। এডিনবার্গের গ্র্যাঞ্জ ক্রিকেট ক্লাব মাঠে স্কটিশ সমর্থকদের সাক্ষী বানিয়ে বিশ^কাপে প্রথম জয়ের উৎসব করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। দলকে প্রথম জয়ের স্বাদ দিতে ২টি করে উইকেট নেন মঞ্জুরুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ, এনামুল হক মণি এবং হাসিবুল হোসেন শান্ত। ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছিল নান্নুর হাতে।

বাংলাদেশের জয়ে বড় অবদান ছিল স্কটল্যান্ডের বোলারদেরও। ম্যাচে ৪৪টি অতিরিক্ত রান দেন স্কটিশ বোলাররা, যা বাংলাদেশ দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ! এতগুলো অতিরিক্ত রান দিয়ে স্কটিশরা ম্যাচ হেরেছিল ২২ রানে! 

দ্বিতীয় জয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ
ওই আসরেই নিজেদের গ্রুপের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, সাইদ আনোয়ার, শোয়েব আক্তারদের নিয়ে গড়া ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দল তখন পাকিস্তান। বিপরীতে বাংলাদেশ প্রথম বার বিশ^কাপে খেলতে নামা দল। দলের কারো বিশ^ব্যাপী তারকা খ্যাতিও নেই। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের 

নেতৃত্বে সেই আনকোরা দলটিই ইতিহাস গড়ে নর্দাম্পটনের কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। পরাশক্তি পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক জয়। সেই জয়টাও ছিল ৬২ রানের বড় ব্যবধানেই। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খানের ৪২, শাহরিয়ার হোসেনের ৩৯ ও এ রকম সবার ছোট ছোট ইনিংসের ভিত্তিতে ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেটে ২২৩ রান করতে পারে বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় পাকিস্তান। খালেদ মাহমুদ সুজনের তোপের মুখে ৪২ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে কাঁপতে থাকে পাকিস্তান। তাদের সেই কাঁপন সময়ের ব্যবধানে আরো বাড়ে। এবং পর্যন্ত ১৬১ রানে অলআউট হয়ে পাকিস্তানিদের মাঠ ছাড়তে হয় হারের বেদনায় নীল হয়ে। ব্যাট হাতে ৩৪ বলে ২৭ রান করার পর বল হাতে ১০ ওভারে মাত্র ৩১ রান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি উইকেট, অলরাউন্ড নৈপূণ্যে ঐতিহাসিক সেই জয়ের ম্যাচে ম্যাচসেরা হন খালেদ মাহমুদ সুজন। পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দিতে তিনি ছাড়াও একটি করে উইকেট নেন মিনহাজুল আবেদীন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, সাইফুদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ রফিক।

তৃতীয় জয়, ভারতের বিপক্ষে, ২০০৭ বিশ্বকাপ
বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় জয়টি পায় ২০০৭ বিশ্বকাপে, অন্যতম পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে। সেই আসরেই বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ১৬টি দল অংশ নেয়। ‘গ্রুপ বি’-তে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বারমুডা। তো গ্রুপপর্বে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটি ছিল ১৭ মার্চ, কুইন্স পার্ক ওভালে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত। যে দলে সৌরভ গাঙুলি, বীরেন্দর শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনিদের মতো বিশ্ব বরেণ্য তারকাদের মিলনমেলা। সেই তারকাসমৃদ্ধ দলটিকে হারিয়ে দেয় মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিকদের বাংলাদেশ। ভারতের অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই মোটামুটি ধাক্কা খেয়ে বসে ভারত। মাশরাফির বলে এজ হয়ে ফিরে যান বিরেন্দর শেবাগ। মাত্র ৬ রানে প্রথম উইকেট হারায় ভারত। এরপর দলীয় ২১ রানে দ্বিতীয় উইকেট এবং দলীয় ৪০ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে বসে টিম ইন্ডিয়া। এরপর সৌরভ গাঙ্গুলি ও যুবরাজ সিং কিছুটা চেষ্টা করেন দলকে টেনে তুলতে। কিন্তু খুব বেশিদূর যাওয়া হয়ে ওঠে না ভারতের। ১৯১ রানেই অলআউট হয়ে যেতে হয়। এ দিন ৯.৩ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন মাশরাফি। আব্দুর রাজ্জাক ও মোহাম্মদ রফিক নেন ৩টি করে উইকেট।

১৯২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে ৪৮.৩ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়েই জয়ের দেখা পায় টিম বাংলাদেশ। দলকে জয় এনে দিতে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান-তিনজনেই করেন হাফসেঞ্চুরি। তামিম ইকবাল ৫১, মুশফিকুর রহিম ৫৬ ও সাকিব আল হাসান ৫৩ রান করেন। ম্যাচসেরার পুরস্কারটি উঠে মাশরাফির হাতে। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ভারতকে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হারলেও, বারমুডাকে হারিয়ে উঠে যায় সুপার এইটে। 

চতুর্থ জয়, বারমুডার বিপক্ষে, ২০০৭ বিশ্বকাপ
২০০৭ আসরে গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে বারমুডার বিপক্ষে জিতে সুপার এইটে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। বৃষ্টি আইনে ম্যাচটিতে জিতে ৭ উইকেটে, ২১ বল বাকি থাকতে। উইকেটের হিসেবে বিশ্বকাপে যেটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় জয়। বৃষ্টির কারণে ২১ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করা বারমুডা ৯ উইকেটে ৯৪ রান তুলতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশের পক্ষে ২০ রানে ৩ উইকেট নেন আবদুর রাজ্জাক। মাশরাফি এবং সাকিব ২টি করে উইকেট পান যথাক্রমে ৮ ও ১২ রানের বিনিময়ে। একটি করে উইকেট নেন সৈয়দ রাসেল ও মোহাম্মদ রফিক। ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশও মাত্র ৩৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বসে। পরে মোহাম্মাদ আশরাফুল ও সাকিবের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ৭ উইকেটের জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। আশরাফুল ৩২ বলে ২৯ এবং সাকিব ৩৫ বলে ২৬ রান করে অপরাজিত থাকেন। ম্যাচসেরার পুরস্কারটি উঠে মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে।

পঞ্চম জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২০০৭ বিশ্বকাপ
ভারতকে টপকে সুপার এইটে উঠলেও এই পর্বে প্রথম দুই ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরে হতাশাজনক অবস্থায় পড়ে টাইগাররা। বাংলাদেশের পরের ম্যাচ ছিল প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবার কথা না সে সময়ে; কিন্তু সেই বাংলাদেশ সেদিন ঠিকই দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেখিয়ে দিতে পেরেছিল নিজেদের সামর্থ্য। জিতেছিল ৬৭ রানে। টসে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৭, তামিম ইকবালের ৩৮, আফতাব আহমেদের ৩৫ রানের ওপর ভর করে ৫০ ওভার শেষে বাংলাদেশ ৮ উইাকেটে ২৫১ রান করতে সক্ষম হয়। পরে বাংলাদেশের বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে মাত্র ১৮৪ রানেই অলআউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতে নেয় ৬৭ রানে। ব্যাটিংয়ে ৮৭ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে প্রোটিয়ারা। সেই চাপ আর সামলে উঠতে পারেনি তারা। হার্শেল গিবসের অপরাজিত ৫৬ রানের ইনিংস ও জ্যাক ক্যালিসের ৩২ রানের ইনিংসের পরও তাই ১৮৪ এর বেশি যেতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশের পক্ষে আব্দুর রাজ্জাক ৯.৪ ওভারে মাত্র ২৫ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন। এ ছাড়া সৈয়দ রাসেল ও সাকিব আল হাসান নেন ২টি করে উইকেট, একটি নেন মোহাম্মদ রফিক। ম্যাচসেরা পুরস্কারের হাসিটা ফুটেছিল আশরাফুলের মুখে।

ষষ্ঠ জয়, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১১ বিশ্বকাপ
টুর্নামেন্টের অন্যতম আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে নামে নিজেদের ঘরের মাঠে। তবে মিরপুরে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ঘরের মাঠের বিশ্বকাপের শুরুটা হয়েছিল ভারতের বিপক্ষে ৮৭ রানের হার দিয়ে; কিন্তু সেই হারের দুঃখ নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই ভুলে যেতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭ রানে জিতে। প্রথমে ব্যাট করে ৪৯.২ ওভারে ২০৫ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। তামিম ৪৪, রকিবুল ৩৮, মুশফিক ৩৬, নাঈম ইসলাম ২৯ রান করেন। জবাবে বাংলাদেশি বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১৭৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় আইরিশরা। ৮ ওভারে মাত্র ২১ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন পেসার শফিউল ইসলাম। সাকিব-আশরাফুল ২টি এবং রাজ্জাক-নাঈম নেন ১টি করে উইকেট। ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ৪৪ রান করা তামিম ইকবাল। তবে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ‘জনতা’র ম্যাচসেরা ছিলেন শফিউল ইসলাম। ম্যাচ শেষে পুরস্কারটি পাওয়া তামিম নিজেও বলেছিলেন, ‘এই পুরস্কারটি আসলে শফিউলেরই প্রাপ্য ছিল।’

সপ্তম জয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১১ বিশ্বকাপ
ঘরের মাটির বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের দ্বিতীয় জয় পায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। চট্টগ্রামে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটিতে বাংলাদেশ পেয়েছিল ২ উইকেটের নাটকীয় জয়। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ৭৮ রানের অলআউট হওয়ার লজ্জায়। সেই হতাশার মধ্যেই ১১ মার্চ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয়। সাকিব, রাজ্জাক, নাঈমের ত্রিমুখী ঘূর্ণির মুখে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংয়ল্যান্ড ২২৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। সাকিব, রাজ্জাক, নাঈম-তিনজনেই নেন ২টি করে উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ বেশ ভালোই শুরু করে কিন্তু মিডল অর্ডারের ব্যাটিং বিপর্যয়ে শেষে হার শঙ্কাই পেয়ে বসেছিল। সেই সময় ব্যাট হাতে রক্ষা-দূত হয়ে আবির্ভাব হন শফিউল ইসলাম। ১৬৯ রানে দলের ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর উইকেটে আসেন তিনি। তখনো জয়ের জন্য দরকার ৫৭ রান। হাতে মাত্র ২টি উইকেট। এই সংকটময় সময়ে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটি বেঁধে শফিউল খেলতে থাকেন খাঁটি ব্যাটসম্যানের মতো। শেষ পর্যন্ত ৫৭ রানের সমীকরণ মিলিয়ে দলকে স্মরণীয় জয়ও উপহার দেন শফিউল। খেলেন ২৪ বলে অপরাজিত ২৪ রানের ইনিংস। মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত থাকেন ২১ রানে। এই ম্যাচেও ‘জনতা’র ম্যাচসেরা ছিলেন শফিউল। কিন্তু আইসিসির ম্যাচ অ্যাডজিকিউটিভ দল পুরস্কারটা তুলে দেন ১০০ বলে ৬০ রান করা ইমরুল কায়েসের হাতে।

অষ্টম জয়, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, ২০১১ বিশ্বকাপ
ঘরের মাটির ওই ২০১১ বিশ্বকাপেই নিজেদের তৃতীয় এবং সব মিলে বিশ্বকাপে অষ্টম জয়টি পায় বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। জিতেছিল ৬ উইকেটে। চট্টগ্রামের সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করে মাত্র ১৬০ রানে অলআউট হয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। বাংলাদেশি বোলারদের পক্ষে রাজ্জাক নেন ৩ উইকেট, একটি করে উইকেট নেন সাকিব, রুবেল ও সোহরাওয়ার্দি শুভ। পরে ১৬১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে বাংলাদেশ ৪১.২ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়েই ছুঁয়ে ফেলে জয় (১৬৬/৪)। স্কোর সমান হওয়ার পর ছক্কা মেরে দলের জয় নিশ্চিত করেন মুশফিকুর রহিম। ১১৩ বলে অপরাজিত ৭৩ রানের ইনিংসের সুবাদে এই ম্যাচেও ম্যাচসেরার পুরস্কার পান ইমরুল কায়েস। এ ছাড়া জুনায়েদ সিদ্দিকী ৩৫, শাহরিয়ার নাফীস ৩৭ রান করেন।

নবম জয়, আফগানিস্তানের বিপক্ষে, ২০১৫ বিশ্বকাপ
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাটির ২০১৫ বিশ্বকাপটা জয় দিয়েই শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ১৮ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল রেকর্ড ১০৫ রানে। রানের হিসাবে এখন পর্যন্ত সেটিই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৬৭ রান সংগ্রহ করে, ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭১ রান করেন মুশফিক। সাকিব করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ রান। এ ছাড়া এনামুল হক বিজয় ২৯, সৌম্য সরকার ২৮, মাহমুদউল্লাহ ২৩, তামিম ১৯ ও মাশরাফি ১৪ রান করেন। জবাবে আফগানিস্তান ১৬২ রানেই গুটিয়ে যায় মাশরাফি-সাকিবদের বোলিং তোপে। মাশরাফি ২০ রান দিয়ে ৩টি, সাকিব ৪৩ রান দিয়ে নেন ২টি উইকেট। একটি করে উইকেট নেন রুবেল, তাসকিন, মাহমুদউল্লাহ। ম্যাচসেরা হন মুশফিক।

দশম জয়, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১৫ বিশ্বকাপ
বাংলাদেশের পরের জয়টি ছিল স্কটল্যান্ডের সঙ্গে এবং সেই জয়টি ছিল যথারীতি রেকর্ড গড়ে। তথাকথিত দুর্বল হলেও প্রথমে ব্যাট করতে নেমে স্কটল্যান্ড ৮ উইকেটে ৩১৮ রান করে। ৩১৯ রানের বিশাল টার্গেট ছুড়ে দেয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশও ব্যাট করতে নেমে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই লক্ষ্যটা ছুঁয়ে ফেলে। ৪৮.১ ওভারেই ৪ উইকেট হারিয়ে করে ফেলে ৩২২। ৬ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশ গড়ে ফেলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এখন অবশ্য বাংলাদেশের এই জয়টা সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডের তালিকার তিন নম্বরে আছে। ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২১ রান করে জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশই আগের ওই জয়টাকে তিনে নামিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ে নতুন করে। নতুন এই রেকর্ড গড়া জয় পেতে তামিম করেন ৯৫ রান। এ ছাড়া মাহমুদউল্লাহ ৬২, মুশফিক ৬০, সাকিব অপরাজিত ৫২ ও সাব্বির রহমান অপরাজিত ৪২ রানের ইনিংস খেলেন। তবে বাংলাদেশিদের হতাশ করে ম্যাচসেরার পুরস্কারটি জিতে নেন স্কটল্যান্ডের কাইল কোয়েৎজার। ব্যাট হাতে তিনি যে খেলেছিলেন ১৩৪ বলে ১৫৬ রানের ইনিংস।

একাদশ জয়-ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১৫ বিশ্বকাপ
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের স্মৃতি নিয়েই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি কীর্তিতে এই ম্যাচেও দারুণ এক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিশ্চিতভাবেই এটা ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশের সেরা জয়গুলোর অন্যতম। রুবেল এক ওভারে ইংল্যান্ডের দুই উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে এক ঐতিহাসিক জয় উপহার দেন। টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি তুলে নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। রিয়াদের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরিতে ৭ উইকেটে ২৭৫ রান করে বাংলাদেশ। দুটি ছক্কা ও ৭ চারে ১৩৮ বলে ১০৩ রান করেন মাহমুদউল্লাহ। ২৭৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে ইংল্যান্ড রুবেল হোসেনের অসাধারণ বোলিং এবং দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২৬০ রানে অল আউট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পায় ১৫ রানের জয়। যে জয় বিশ^কাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে। ৪৯তম ওভারে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেটে তুলে নেওয়া রুবেল ম্যাচে মোট ৪ উইকেট নেন ৫৩ রান খরচায়। তবে ম্যাচ সেরার পুরস্কারটি ওঠে দেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরির কীর্তি গড়া মাহমুদউল্লাহর হাতে।

দ্বাদশ জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২০১৯ বিশ্বকাপ
২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২ জুন দ্য ওভালে। টসে জিতে প্রথমে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ৩৩০ রানের বিশাল পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ডের মর্যাদা পায়। একই সঙ্গে ওই সময়ে এটাই ছিল ওয়ানডেতে ক্রিকেটেও দেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড। তবে পরে এ দুটি রেকর্ডই ভেঙে যায়। ওই ২০১৯ বিশ্বকাপেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নটিংহামে ৮ উইকেটে ৩৩৩ রান করে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ এবং সেটা বিশ্বকাপ এবং ওভার ওয়ানডে-দুটোতেই। এখনো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই ৩৩৩/৮-ই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড হয়ে আছে। তবে ওভার অল ওয়ানডেতে রেকর্ডটি ভেঙে বাংলাদেশ দলীয় সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড গড়েছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে- ৬ উইকেটে ৩৪৯, গত ২০ মার্চ, সিলেটে। সেদিন ওভালে বাংলাদেশকে তৎকালীন ওই রেকর্ড পুঁজি এনে দেওয়ার পথে বড় ভূমিকা রাখেন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। তৃতীয় উইকেটে ১৪২ রানের জুটি গড়েন তারা, যা তখন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড ছিল।  সেদিন ১৪২ রানের জুটি গড়ার পথে সাকিব করেন ৭৫ রান, মুশফিক করেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮১। ৩৩১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩০৯ রান করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ পায় ২১ রানের জয়। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট নেন মুস্তাফিজ। এ ছাড়া সাইফুদ্দিন ২টি, সাকিব ও মিরাজ নেন একটি করে উইকেট। ৭৫ রান ও ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন সাকিব।

ত্রয়োদশ জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ২০১৯ বিশ্বকাপ
আসরের পঞ্চম ম্যাচে বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজেদের ১৩তম জয় পায় বাংলাদেশ। টসে জিতে ফিল্ডিং নেয় বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে নেমে ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩২১ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয়দের পক্ষে সর্বোচ্চ ৯৬ রান করেন শাই হোপ। এভিন লুইস ৭০, শিমরান হেটমেয়ার করেন ৫০ রান। বাংলাদেশের পক্ষে ৩টি করে উইকেট নেন মুস্তাফিজ ও সাইফুদ্দিন। সাকিব আল হাসান নেন ২ উইকেট। জবাবে সাকিব আল হাসানের ৯৯ বলে ১২৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে চড়ে ৩ উইকেট হারিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ (৩২২/৩)। গড়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। নিজেদের ইতিহাসে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডও। দুটি রেকর্ডই অক্ষত। দলকে এই রেকর্ডময় জয় এনে দেওয়ার পথে সাকিব ও লিটন দাস মিলে চতুর্থ উইকেটে গড়েন ১৮৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড। রেকর্ডের পথে লিটন দাস করেন অপরাজিত ৯৪ রান, ৪টি ছক্কা ও ৮ চারে মাত্র ৬৯ বলে। অল-রাউন্ড নৈপুণ্যে এই ম্যাচেও ম্যাচসেরা হন সাকিব।

চতুর্দশ জয়, আফগানিস্তানের বিপক্ষে, ২০১৯ বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের চৌদ্দতম জয় পায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে. ২৪ জুন সাউদাম্পটনে। প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে মুশফিকুর রহিমের ৮৭ বলে ৮৩ রানের ইনিংসের সুবাদে ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৬২ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। মুশফিক ছাড়াও সাকিব ৫১, তামিম ৩৬, মোসাদ্দেক ৩৫ রান করেন। জবাবে বাংলাদেশের বোলারদের তোপের মুখে ৩ ওভার বাকি থাকতেই ২০০ রানে অলআউট হয়ে যায় আফগানিস্তান। ১০ ওভারে মাত্র ২৯ রান দিয়ে ৫ উইকেট তুলে নেন সাকিব আল হাসান, যা বিশ্বকাপে কোনো বাংলাদেশি বোলারের প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার। পরে মুস্তাফিজ ওই ২০১৯ বিশ্বকাপেই দুই বার ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন, ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশি বোলারদের ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি এই ৩টিই। তবে মুস্তাফিজ দুইবার ৫ উইকেট নিলেও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা বোলিং কীর্তিটা সাকিবের দখলেই। আফগানদের বিপক্ষে ওই ৫/২৯। মুস্তাফিজ ৫ উইকেট পাওয়া দুইবারই সাকিবের চেয়ে বেশি রান দিয়েছেন। সেদিন সাউদাম্পটনে সাকিবের বোলিং কীর্তির দিনে মুস্তাফিজও নেন ২ উইকেট। তবে ম্যাচসেরার পুরস্কারটি ওঠে সাকিবের হাতেই। ২০১৯ বিশ^কাপে বাংলাদেশের ৩টি জয়ের ৩টিতেই ম্যাচসেরা হন সাকিব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //