বিশ্বকাপে ইতিহাস লিখলেন শরফুদ্দৌলা

ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচ চলছে। সেই ম্যাচে একজন বাংলাদেশি অন ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বোলিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বোলারের ডেলিভারি দেওয়া বলের দিকে। বোলার-ফিল্ডাররা মিলে সমস্বরে আবেদন করলে কখনো সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে ব্যাটসম্যানকে আউট ঘোষণা করছেন। ব্যাটসম্যান নতমস্তকে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে হাঁটছেন প্যাভিলিয়নের পথে। আবার কখনো বোলার-ফিল্ডারদের আবেদন হাত বা মাথা নেড়ে নাকচ করে দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বোলার হতাশ বদনে ফিরে যাচ্ছেন নিজের বোলিং লাইনআপে।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই কল্পনার দৃশ্যটা এখন আর কল্পনাই নেয়। এই কল্পনার দৃশ্যটাই আসন্ন বিশ্বকাপে ফুটে উঠেছে। ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ (যিনি শরফুদ্দৌলা সৈকত বা সংক্ষেপে সৈকত নামেই বেশি পরিচিত।) এবং সেটা অন ফিল্ড আম্পায়ার, তৃতীয় আম্পায়ার (টিভি আম্পায়ার) ও চতুর্থ আম্পায়ার-তিন ভূমিকাতেই। 

মানে ভারত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে নতুন এক ইতিহাসের সূচনা করেছেন শরফুদ্দৌলা, ভাবতেই গর্বে-আনন্দে বুকটা ভরে উঠছে! এবারের বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো পরিচালনার জন্য আইসিসি যে ১৬ জন আম্পায়ার নির্বাচন করেছে, তার একজন শরফুদ্দৌলা সৈকত। 

তবে শুধু তালিকায় নাম থাকলেই তো আর স্বপ্ন পূরণ হয় না। তালিকায় নাম থাকার পরও একজনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল হওয়ার দৃষ্টান্ত তো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সামনেই আছে- এনামুল হক মণি। ২০১১ সালে ঘরের মাটির বিশ্বকাপে এনামুল হক মণি বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে বিশ্বকাপের জন্য আইসিসির নির্বাচিত আম্পায়ার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। তবে এনামুল হক মণির জায়গা হয়েছিল রিজার্ভ আম্পায়ার তালিকায়।

তারপরও হয়তো রঙিন রং তুলি দিয়ে মনের পর্দায় বিশ্বকাপের ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন এঁকে ছিলেন মণি; কিন্তু মণির সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। দুর্ভাগ্য তার, দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের, এনামুল হক মণির ভাগ্যে মাঠে গিয়ে ম্যাচ পরিচালনা করার সৌভাগ্য হয়নি। আইসিসি তাকে তালিকাতেই রেখেছিল শুধু। 

তবে শরফুদ্দৌলা সৈকতের পূর্বসূরি এনামুল হক মণির মতো স্বপ্ন চুরমার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বেঁচে থাকলে এবং শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে ভারত বিশ্বকাপে ইতিহাসটা লিখে ফেলবেন শরফুদ্দৌলা। গড়বেন বাংলাদেশের গর্বের ইতিহাস। তাও একটি, দুটি নয়, তিন ভূমিকায় ভারত বিশ্বকাপে মোট ১১টি ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্ব সামলাবেন শরফুদ্দৌলা! চতুর্থ আম্পায়ার হিসেবে ৩টি ও তৃতীয় আম্পায়ার হিসেবে ৩টিও অন ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে পরিচালনা করবেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ম্যাচসহ মোট ৫টি ম্যাচে।

২০২৩ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের ৪৫ ম্যাচের অন ফিল্ড আম্পায়ার, তৃতীয় আম্পায়ার ও চতুর্থ আম্পায়ারদের নাম ঘোষণা করেছে আইসিসি। সেমিফাইনাল ও ফাইনালের আম্পায়ার প্যানেলের নাম ঘোষণা করা হবে গ্রুপপর্বের শেষে। আইসিসির ঘোষণাপত্রে জানা যাচ্ছে, ৫ অক্টোবর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচেই ইতিহাসের একটা পাঠ লিখলেন ৪৬ বছর বয়সি শরফুদ্দৌলা। সেদিন তার বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছে চতুর্থ আম্পায়ার হিসেবে। এই ভূমিকায় সেদিন তার সহযোদ্ধা ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পল উইলসন। ম্যাচটির অন ফিল্ড আম্পায়ারের দায়িত্বে ছিলেন শ্রীলঙ্কার কুমার ধর্মসেনা ও ভারতের নিতিন মেনন।

শরফুদ্দৌলা অন ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে প্রথম দাঁড়িয়েছিলেন ৭ অক্টোবর, দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচে। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলও প্রথম মাঠে নেমেছে সেদিনই। ধর্মশালায় আফগানিস্তানের মুখোমুখি হয় সাকিব আল হাসানের দল। মানে বাংলাদেশের ম্যাচের দিনেই ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে বিশ্বকাপ ম্যাচ পরিচালনার ইতিহাস লিখলেন শরফুদ্দৌলা। 

দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ ছাড়াও তিনি ১৫ অক্টোবর ইংল্যান্ড-আফগানিস্তান, ২৫ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া-নেদারল্যান্ডস, ২৮ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ও ৩ নভেম্বর নেদারল্যান্ডস-আফগানিস্তান ম্যাচে ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

শরফুদ্দৌলা এরই মধ্যে ছেলেদের ক্রিকেটে মোট ১০৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ (৯টি টেস্ট, ৫২টি ওয়ানডে ও ৪৩টি টি-টোয়েন্টি) পরিচালনা করেছেন। গত এপ্রিলে ছুঁয়েছেন প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার মাইলফলক। পাশাপাশি মেয়েদের ক্রিকেটেও ১৩টি ওয়ানডে ও ২৮টি টি-টোয়েন্টি পরিচালনা করেছেন। সব মিলে ১৫৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। 

এছাড়া ছোটদের বিশ্বকাপ এবং মেয়েদের একাধিক বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন শরফুদ্দৌলা। ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাই, ২০১৮ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৯ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাই, ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, ২০২২ নারী বিশ্বকাপ এবং ২০২৩ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই আম্পায়ারের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

আম্পায়ারিংয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের অতৃপ্তিটা অনেকাংশে মুছে ফেলেছেন। বিশ্বকাপের ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন পূরণ হলে খেলোয়াড়ি জীবনের 

অতৃপ্তিটা হয়তো পুরোপুরিই মুছে যাবে। আম্পায়ারিংয়ে নাম লেখানোর আগে ক্রিকেটই খেলেছেন তিনি। বাঁ-হাতি স্পিনার শরফুদ্দৌলা খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় হলের হয়েও- ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ৭ ম্যাচের শেষ তিনটিতে খেলার সুযোগ পান তিনি। সেই তিন ম্যাচেই ২টি করে মোট ৬ উইকেট লাভ করেছিলেন। জাতীয় দলের হয়ে খেললেও ওই ম্যাচগুলো ওয়ানডে মর্যাদা পায়নি। যাই হোক, তিন ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে শরফুদ্দৌলা আভাস দিয়েছিলেন জাতীয় দলের হয়ে ভালো কিছু করার; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ারটা লম্বা হয়নি। ওই টুর্নামেন্টের পর জাতীয় দলে আর ডাকই পাননি তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //