ভারতীয় দর্শকদের জাগাতে পারেনি বিশ্বকাপ ক্রিকেট

ভারতীয়দের কাছে ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা ধর্মের মতো। ক্রিকেটে বিমোহিত ভারতীয় দর্শকরা ক্রিকেটারদের পূজা করে দেবতাজ্ঞানে। যে কারণে ভারতে কখনো ক্রিকেট দর্শকের অভাব হয় না। হোক সেটা কোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ কিংবা ঘরোয়া আইপিএল ম্যাচ। গ্যালারিভর্তি দর্শক ঠিকই প্রিয় দলের জন্য গলা ফাটাতে হাজির থাকে স্টেডিয়ামগুলোতে। অথচ ভারতের মাটিতেই চলমান আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে দর্শকখরা চলছে। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। 

৫ অক্টোবর থেকে মাঠে গড়িয়েছে আইসিসি আয়োজিত ১৩তম ওয়ানডে বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো আসরের একক আয়োজক ভারত। ধারণা করা হয়েছিল, দেড়শ কোটি জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বকাপে গড়বে স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিতির নতুন রেকর্ড। কিন্তু কোথায় কী! ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে বিরান গ্যালারি। উদ্বোধনী ম্যাচের টিভি ক্যামেরাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হয়েছে গ্যালারির দর্শক। অথচ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বরাতে জানা গেছে, ইংল্যান্ড বনাম নিউজিল্যান্ড ম্যাচের জন্য আহমেদাবাদের কয়েক হাজার নারীকে ফ্রি টিকিট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্বোধনী ম্যাচে দর্শক কেন হয়নি? শোনা গিয়েছিল, বলিউডের রথী-মহারথীদের অংশগ্রহণে আয়োজন করা হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উপস্থাপন করা হবে ভারতের হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যও। বাস্তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াই মাঠে গড়িয়েছে বিশ্বকাপ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান না থাকার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি আইসিসি কিংবা বিসিসিআই। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সম্ভাব্য একাধিক কারণ হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ধরা হচ্ছে খালিস্তানি নেতার হুমকি। কানাডার নাগরিক ও খালিস্তান আন্দোলনের নেতা শিখ হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার বদলা নিতে বিশ্বকাপের আসরে হামলার হুমকি দিয়েছে ভারতে নিষিদ্ধ শিখ সম্প্রদায়ের সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর নেতা গুরপতবন্ত পান্নুন। অনেকে মনে করছেন, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য শেষ মুহূর্তে ভারত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। 

১৩তম আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে ১০টি দেশ। খেলা হচ্ছে লিগ পদ্ধতিতে। ইতোমধ্যে ১০টি দেশের অন্তত একটি করে খেলা শেষ। কিন্তু ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কোনো ম্যাচেই পাওয়া যায়নি দর্শকের উপস্থিতি। শুধু স্বাগতিকদের ম্যাচ দেখতে চেন্নাইয়ের চিন্দাভরম স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিল ৩৩ হাজার সমর্থক। বোঝা গেছে, ভারতীয়রা নিজ দেশের বাইরে অন্য কারও খেলা দেখতে আগ্রহী না। আবার পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার নাগরিকদের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কঠোর করা হয়েছে ভারতের ভিসানীতি। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উপমহাদেশের দর্শকদের একটা বিরাট অংশ মাঠে উপস্থিত থেকে নিজ দেশকে সমর্থন জানাতে পারছে না। 

যা-ই হোক, দর্শকখরা আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিলের সমালোচনা পাশ কাটিয়ে বিশ্বকাপের শুরুটা মন্দ হয়নি। প্রথম ম্যাচেই ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হারের প্রতিশোধ নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। প্রতিযোগিতার প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন দুই কিউই ব্যাটার ডেভন কনওয়ে আর রাচিন রবীন্দ্র। নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ম্যাচেও জয় পেয়েছে হল্যান্ডের বিপক্ষে। পাকিস্তান নিজেদের প্রথম ম্যাচে ৮১ রানের প্রত্যাশিত জয় পেয়েছে হল্যান্ডের বিপক্ষে। বাংলাদেশ ৬ উইকেটে আফগানিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপে শুভসূচনা করেছে। ধর্মশালায় বাংলাদেশের জয়ের নায়ক ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় এসেছে দলীয় বোঝাপড়ায়। সাকিব আল হাসান তিনটি, শরিফুল দুটি, তাসকিন আর মোস্তাফিজের একটি করে উইকেট শিকারে বাংলাদেশ ১৫৬ রানেই গুটিয়ে দেয় আফগান ইনিংস। পরে মিরাজ ছাড়াও হাফ সেঞ্চুরি হাঁকান নাজমুল হোসেন শান্ত। তার ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ৫৯ রান। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স উদ্বোধনী ম্যাচে আশা জাগানিয়া ছিল। যদিও পরের ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচটি ছিল হতাশার।

শ্রীলংকা আর দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচে বয়ে গেছে রান আর রেকর্ডের বন্যা। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৪২৮ রানের ইনিংস গড়ে প্রোটিয়ারা। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি তিনবার আর ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ আটবার ইনিংসে ৪শ রানের রেকর্ডের মালিক দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জের সামনে ৩২৬ রানে গুটিয়ে যায় শ্রীলংকা। একই সঙ্গে ম্যাচে দুই দল মিলিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৭৪৮ রানের রেকর্ড গড়ে। 

বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো একই ইনিংসে দেখা মেলে তিন সেঞ্চুরির। তিনটি সেঞ্চুরির মালিক দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার কুইন্টন ডি কক, রসি ভ্যান ডার ডুসেন আর এইডেন মার্করাম। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সব মিলিয়ে চার ম্যাচে একই ইনিংসে তিনটি সেঞ্চুরির ঘটনা আছে। শ্রীলংকার বিপক্ষে মাত্র ৪৯ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মার্করাম। যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ড ব্যাটার কেভিন ও’ব্রায়ানের ৫০ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙেন তিনি। 

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ৬ উইকেটে জিতেছে ভারত। অজিদের ছুড়ে দেওয়া ২০০ রানের টার্গেট তাড়ায় ভারতীয়রা ২ রানে হারায় তিন উইকেট। বিশ্বকাপে বিনা রানে ভারতের শুরুর তিন ব্যাটার আউট হওয়ার ঘটনা প্রথম। তবে বিরাট কোহলি আর লোকেশ রাহুলের ১৬৫ রানের জুটি ভারতকে দেখায় জয়ের পথ। বিরাটের ৮৫ রানের ইনিংসে সৃষ্টি হয় নতুন বিশ্বরেকর্ড। টার্গেট তাড়ায় জয় তুলে নেওয়া ম্যাচে বিরাটের ঝুলিতে জমা হয়েছে ৫৫১৭ রান। এত দিন ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে জয় তুলে নেওয়া ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রানের বিশ্বরেকর্ড ছিল শচীন টেন্ডুলকারের। এদিকে বিরাট বনে গেছেন ভারতের পক্ষে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ক্যাচের মালিকও। মিচেল মার্শের ক্যাচটি ছিল বিশ্বকাপে তার ১৫তম। ছাড়িয়ে যান ১৪ ক্যাচ নিয়ে অনিল কুম্বলের রেকর্ড। 

বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড শেষ হয়েছে। সব দলকে খেলতে হবে ৯ রাউন্ড। তারপর আসবে সেমিফাইনালের প্রশ্ন। বলা যায়, বিশ্বকাপ লড়াই মাত্র শুরু। প্রথম রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকা আলোড়ন তুলেছে। কিন্তু সামনে বহু উত্থান-পতন অপেক্ষমাণ। চলমান বিশ্বকাপ যেহেতু ৪৫ দিনের দীর্ঘ পরিক্রমা, তাই বহু নতুন রেকর্ড আর কীর্তি দেখা যাবে নিঃসন্দেহে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //