দুয়োধ্বনির
শুরুটা হয়েছিল ভারতের বিপরীতে টসে হেরে পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন
সে সময়, কিন্তু এর রেশটা ছিল খেলা শেষ হওয়ার পরও বহুক্ষণ পর্যন্ত।
এবারের
চলমান আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর ভারতে হওয়ায় পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা খেলার মাঠে
দর্শকের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন মুসলিম বিদ্বেষ, ঘৃণা ও বৈরী আচরণ।
ম্যাচটি
শুরু হওয়ার সাথে সাথে এবং পাকিস্তানি সমর্থকদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা কার্যত
নিষিদ্ধ করার কারণে, স্টেডিয়ামে দর্শকদের পক্ষপাতমূলক প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারণ
পাকিস্তানি ব্যাটারদের করা যেকোনো বাউন্ডারিতে পিনপতন নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।
এর
আগে, গত সপ্তাহের শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রান তাড়া করার সময় পাকিস্তানের মুহাম্মদ রিজওয়ান যখন আউট হওয়ার পর প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন, তখন ওয়াকওয়ের চারপাশের
জনতা তাকে “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিয়ে ঠাট্টা করে স্বাগত জানায়। হিন্দি-ভাষার এই
স্লোগানটি হিন্দু উগ্র-ডান গোষ্ঠীগুলি প্রায়শই দেশটির মুসলিম জনগনকে হেয় ও অসম্মানিত
করতে ব্যবহার করে থাকে।
ম্যাচটিতে
পাকিস্তান ৪২.৫ ওভারে ১৯১ রান করে আউট হয়ে যায়, যা ভারতীয় ব্যাটাররা অনায়াসে সংগ্রহ
করে ফেলে।
ভারতের
অধিনায়ক রোহিত শর্মা যখন ছয়টি ছক্কা এবং ছয়টি চার মেরে যখন ভারত শিবিরে স্বস্তি
এনে দেন, তখন গেরুয়া রঙের স্ট্যান্ডে উপবিষ্ট হাজার হাজার সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে।
ভারতীয় জনতা এসময় সমর্থকবিহীন পাকিস্তান দলের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতেও পিছপা হয়নি।
পাকিস্তানের
ক্রিকেটাররা যখন প্যাভিলিয়ন পেরিয়ে ফিল্ডিং করতে মাঠে নামছিল তখন উল্লসিত জনতা উস্কানিমূলক
শ্লোগান দিচ্ছিল।
ভারতীয়
ক্রীড়া লেখক কার্তিক কৃষ্ণাস্বামী ভারতীয় সমর্থকদের এহেন আচরণকে ‘নির্দয় মুসলিম বিদ্বেষ’
বলে অভিহিত করেছেন এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার আহ্বান
জানিয়েছেন।
তবে প্রবীণ
ক্রিকেট লেখক কুলদীপ লাল মনে করেন, বিজেপি সমর্থক ও উল্লসিত জনতার এহেন আচরণের
সাথে স্টেডিয়ামের অবস্থান ও আহমেদাবাদের অনেক সম্পর্ক রয়েছে।
তিনি
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘‘ভারতে যদি এমন একটি স্থান থেকে থাকে যেখানে
জনসাধারণের পাকিস্তানবিরোধী প্রবল মনোভাব রয়েছে, তা হল আহমেদাবাদ।’’
‘‘আমার
৩০ বছরের ক্রিকেট কভার করার সময়, আমি ভারতের অন্য কোথাও এমন বৈরিতা দেখিনি,’’ তিনি
বলেছিলেন।
শনিবার
পাকিস্তানকে দেওয়া সংবর্ধনাটি তাদের আগের দুটি ম্যাচেরও সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, যা দক্ষিণের
শহর হায়দ্রাবাদে খেলা হয়েছিল।
হায়দরাবাদের
জনতা বাবরকে সমর্থন দিয়ে চিৎকার করছিল যখন তিনি মাঠে নেমেছিলেন এবং রিজওয়ানের জন্য
উল্লাস করছিলেন যখন তিনি তার দলকে সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছিলেন।
লাল মনে করেন যে চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরুর মতো আরও কিছু বিখ্যাত ভারতীয় ক্রিকেট ভেন্যুতে
স্থানীয়রা ঐতিহ্যগতভাবে ভাল ক্রীড়া অনুরাগী যারা রাজনীতির অতিরিক্ত উদ্যমী প্রদর্শনের
পরিবর্তে খেলাটির প্রশংসা করে।
তিনি
বলেন, আহমেদাবাদের লোকেরা ম্যাচ উপভোগ করার জন্য সেখানে ছিল না, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক
এজেন্ডা ছিল।
এ
প্রসঙ্গে পাকিস্তানের হেড কোচ মিকি আর্থার ম্যাচ শেষে বলেন, “সত্যি বলতে এটা বিশ্বকাপের
ম্যাচ বলেই মনে হয়নি, মনে হয়েছে বিসিসিআইয়ের কোনও ইভেন্ট।”
এদিকে, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে কেন্দ্র করে ‘শেম অন বিসিসিআই’ -এখন টুইটারে ট্রেন্ডিং। ভারতের চরমপন্থী সংগঠন শিব সেনার এক নেতা উদ্ভব ঠাকরে ‘শেম অন বিসিসিআই’ -হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিসিসিআইয়ের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন টুইটারে।
তিনি গুজরাটে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অভ্যর্থনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘আজ বিসিসিআই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ফুল দিয়ে বরণ করেছে, যারা আমাদের সৈনিকদের ওপর বুলেট ছুড়েছে। বিজেপির এই নেতারাই কি আবার সৈনিকদের ছবি নির্বাচনের সময় প্রচারণায় ব্যবহার করবেন? যারা এখন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে স্বাগত জানাচ্ছে?’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এই মানুষগুলো ভারতীয় সৈনিকদের মৃত্যুর কষ্টটা হৃদয়ে ধারণ করেন না। তারা শুধু নির্বাচনের সময় দেশপ্রেম ও যুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বলেন। পাকিস্তানের জন্য লাল গালিচা বিছাতে তাদের কোনও লজ্জা হয় না।’ তবে এ বিষয়ে বিসিসিআইয়ের তরফ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দল ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরে এবারই প্রথম ভারতের মাটিতে খেলতে গেল। প্রায় ১৫ বছর ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেটীয় সম্পর্কে রাজনৈতিক প্রভাব তুঙ্গে রয়েছে, যে কারণে ২০১৩ সালের পর এই দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র একে অপরের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক কোনও সিরিজেও মুখোমুখি হয়নি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh