উড়ন্ত টিম ইন্ডিয়াকে থামাবে কে

বিশ্বকাপটা কি ভারতের হাতেই যাচ্ছে? বলার সময় এখনো আসেনি। তবে নিজেদের মাটিতে চলা আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে রকেট গতিতে ছুটছে টিম ইন্ডিয়া। স্বাগতিকদের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা উড়ে যাচ্ছে খড়কুটোর মতো। ঘরের মাঠে পরিচিত কন্ডিশনে ভারতীয়রা ঐতিহ্যগতভাবেই দুর্বার। ২০১১ সালেও নিজেদের মাটিতে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে বিশ্বকাপ দখলে নিয়েছিল তারা। তবে সেই আসরে যৌথ আয়োজক হিসেবে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচ ছাড়া বাকি সব ম্যাচ ভারত খেলেছে নিজেদের মাঠে। আর চলতি আসরের একক স্বাগতিক ভারত তো শুরু থেকেই ‘হট ফেভারিট’।

২২ অক্টোবর ভারত টানা পঞ্চম জয় তুলে নিয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এই জয়ে সেমিফাইনালের কাছাকাছি টিম ইন্ডিয়া। টুর্নামেন্টে প্রতিটা দলের পাঁচ ম্যাচ শেষে একমাত্র অপরাজেয় দলও তারাই। আর কিউইরা পেয়েছে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ। কিউইদের বিপক্ষে শচিন টেনন্ডুলকারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হেলায় হারিয়েছেন বিরাট কোহলি। ৯৫ রানে আউট হয়েছেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক। তাতে পাওয়া হয়নি ৪৯তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ছোঁয়া হয়নি একদিনের ক্রিকেটে টেন্ডুলকারের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা কোহলি পাঁচ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩৫৪ রান করেছেন। হাঁকিয়েছেন দুটি হাফ সেঞ্চুরি আর একটি সেঞ্চুরি। রোহিতও ৩১১ রান নিয়ে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বোলিংয়ে আগুন ঝরাচ্ছেন জাশপ্রিত বুমরাহ, কুলদীপ যাদব আর রবীন্দ্র জাদেজারা। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’ ভারতীয়রা এগিয়ে চলেছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে।

৫ অক্টোবর মাঠে গড়ানো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সপ্তাহে বড় অঘটনের জন্ম দিয়েছে হল্যান্ড। ‘পুঁচকে’ দেশটির কাছে নাকাল হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। চলতি আসরেই শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডকে পাত্তা দেয়নি প্রোটিয়ারা। আবার হল্যান্ডের কাছে হারার ঝাল দক্ষিণ আফ্রিকা মিটিয়েছে ইংল্যান্ডের ওপর। বিগত আসরের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে নিয়ে যত কম বলা যায় তত ভালো। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২২৯ রানে হারের লজ্জায় ডুবেছে ইংলিশরা। রানের দিক থেকে ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় হার এটি। বিশ্বকাপে এই প্রথম দুইশর বেশি রানে হারল ইংল্যান্ড। এছাড়া ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ৩৯৯ রান তোলার রেকর্ডও গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইতোমধ্যে চার ম্যাচের তিনটিতে হেরে বসে আছে ইংলিশরা। ব্যাটে-বলে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন ক্রিকেটাররা। আসরের সেরা ১৫-তে নেই ইংলিশ কোনো ব্যাটার। ডেভিড মালান দলের হয়ে একটি সেঞ্চুরিসহ ১৯২ রান করেছেন। জো রুট আর হ্যারি ব্রুক ছাড়া কারও ১০০ রান নেই। ৮ উইকেট নেওয়া রিসে টপলি সেরা ইংলিশ বোলার। কিন্তু সেই টপলির বিশ্বকাপ শেষ। ইনজুরি-আক্রান্ত টপলির জায়গায় নেওয়া হয়েছে ব্রাইডন কার্সকে। ছন্দে থাকা একমাত্র বোলারকে হারিয়ে ইংল্যান্ডের পথচলা কঠিন হবে, নিঃসন্দেহে।

চলতি বিশ্বকাপের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রতিটা দল জয়ের দেখা পেয়েছে। যা ৩১ বছরে প্রথম। ১৯৯২ সালে শেষবার ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৯টি দলের প্রত্যেকে অন্তত একটি জয়ের দেখা পেয়েছিল। খেলা হয়েছিল বর্তমান ফরম্যাটের মতোই লিগ পদ্ধতিতে। ভারত ছাড়া এশিয়ার দুই পরাশক্তি শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানের সময় ভালো কাটছে না। দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়ের হ্যাটট্রিক পূরণ করেছে লঙ্কানরা। তবে শেষ পর্যন্ত হল্যান্ডকে হারিয়ে দেখেছে জয়ের মুখ। অন্যদিকে টানা দুই জয়ের পর পথ হারিয়েছে পাকিস্তান। হেরেছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাকিস্তানের পরাজয় আশা করেনি কেউ। কিন্তু ইংল্যান্ডের পর পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানরা বিশ্বকাপের আলোচিত দল। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেওয়া আফগানিস্তান হারিয়েছিল স্কটল্যান্ডকে। বিগত আসরে হেরেছিল ৯টি ম্যাচেই। এবারেই প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপের এক আসরে দুই জয়ের মুখ দেখেছে আফগানরা। শুধু তাই না, পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটের অষ্টম দেখায় প্রথম জয় পেল আফগানিস্তান। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৮২ রান তাড়ায় ৮ উইকেটে জয় পেয়েছে আফগানিস্তান। যা ওয়ানডে ক্রিকেটে আফগানদের সবচেয়ে বড় টার্গেট পূরণে জয়ের রেকর্ড। 

বাজে শুরুর পর নিজেদের ফিরে পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। প্যাট কামিন্সরা ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে শুরুতেই হেরে বসে। কিন্তু পরবর্তী দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানকে হারিয়ে কক্ষপথে তারা। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৩৬৭ রানের ইনিংস গড়ে অজিরা। ডেভিড ওয়ার্নার-মিচেল মার্শের চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী জুটিতে যোগ হয় ২৫৯ রান। যা বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সেরা উদ্বোধনী জুটি, ওয়ানডেতে তৃতীয় সর্বোচ্চ এবং বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা উদ্বোধনী জুটি। বিশ্বকাপে সেরা উদ্বোধনী জুটি শ্রীলঙ্কার তিলকারত্নে দিলশান ও উপুল থারাঙ্গার, ২৮২ রানের। ম্যাচে ১৬৩ রান করেন ওয়ার্নার। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা চার ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পেলেন অজি ওপেনার। যা নির্দিষ্ট দলের বিপক্ষে টানা সেঞ্চুরির যৌথ বিশ্বরেকর্ড। ২০১৭-১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা চার সেঞ্চুরি করেছিলেন কোহলি। বিশ্বকাপে একমাত্র ব্যাটার হিসেবে তিনটি ১৫০+ ইনিংসের রেকর্ড এখন ওয়ার্নারের। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৭৮ আর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৬৬ রান এসেছিল ওয়ার্নারের ব্যাট থেকে। শুধু তাই না, রিকি পন্টিং ও স্টিভ ওয়াহর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তৃতীয় অজি খেলোয়াড় হিসেবে ১৮ হাজার রানের সীমা ছুঁয়েছেন ওয়ার্নার।

প্রথম দুই ম্যাচে নিজেদের খুঁজে না পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। ওয়ানডে বিশ্বকাপের সর্বাধিক পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন তারা। প্রতিকূল পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার কৌশল তাদের জানা। ৯ উইকেট দখলে নেওয়া অ্যাডাম জাম্পা ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড আর কামিন্সরা নিজেদের ফিরে পেতে শুরু করেছেন। বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ কেবল শুরু।

বাংলাদেশ দল রয়েছে বেকায়দায়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরুর পর টানা হার। ভারতের বিপক্ষে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ইনজুরি সমস্যায় খেলতে পারেননি। তবে চমক দেখিয়েছিল ওপেনিং জুটি। তানজিদ হাসান আর লিটন দাস গড়েন ৯৩ রানের জুটি। দুজনেই করেন হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু পরে নিয়মিত উইকেট হারানো বাংলাদেশের ইনিংসে শেষ হয় ২৫৬ রানে। বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, সব ডিপার্টমেন্টের একসঙ্গে জ্বলে উঠতে না পারা। ভারতের বিপক্ষে ওপেনিং জুটি সফল, ব্যর্থ মিডল অর্ডার। বল হাতে শরিফুল আর মোস্তাফিজরা বিন্দুমাত্র চাপে ফেলতে পারেনি ভারতকে। কোহলির সেঞ্চুরিতে অনায়াসে স্বাগতিকরা ম্যাচ জিতেছে ৭ উইকেট। আপাতত বাংলাদেশ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। সমীকরণ একটাই, শেষ পাঁচ ম্যাচের অন্তত চারটি জিততে না পারলে টাইগারদের বিদায় নিতে হবে লিগ পর্ব থেকেই। যা আপাতত হিমালয় পাড়ি দেওয়ার চেয়ে কঠিন মনে হচ্ছে।

শেষ করা যাক এবারের বিশ্বকাপের উইকেট-চরিত্র নিয়ে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভারত সবসময় স্পিন সহায়ক উইকেট বানায়, এই অভিযোগ বহু পুরনো। অথচ চলতি বিশ্বকাপে রাজত্ব করছেন পেসাররা। পাঁচ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে মিচেল স্যান্টনার বোলিং তালিকায় শীর্ষে। ১১ উইকেট নিয়ে ভারতের বুমরাহ আর লংকান দিলশান মাদুশাংকা দ্বিতীয় সেরা। ম্যাট হেনরি আর শাহিন শাহ আফ্রিদি ১০ উইকেট শিকার করেছেন। লকি ফার্গুসন, টপলি, কাগিসো রাবাদা, হ্যারিস রউফ, মার্কো জেনসেনরা নিয়েছেন ৮টি করে উইকেট। তারা সকলে গতিদানব। তাহলে কি স্পিনাররা ব্যর্থ? মোটেও নাজাম্পা ৯টি, কুলদীপ যাদব ৮টি, রবীন্দ্র জাদেজা ৭টি আর কেশব মহারাজ এবং আদিল রশিদদের ৬টি করে উইকেট বলছে স্পিনারদের সাফল্যগাথা। পাঁচ উইকেট করে নেওয়া বাংলাদেশের সাকিব আর মিরাজদের সাফল্য স্পিনারদের হয়ে কথা বলছে। 

কিন্তু ম্যাচ জেতাচ্ছে ব্যাটাররা। প্রথম দুই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ২০০ রান করতে পারেনি, হেরেছে। ব্যাটাররা রানে ফিরতেই অজিরা জয় পেতে শুরু করেছে। বর্তমানে একদিনের ক্রিকেটে ৩০০ রানও নিরাপদ না। বিশ্বকাপের রেকর্ড রান তাড়ায় জয়ের রেকর্ড গড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বলা যায়, রানের উৎসব চলছে ভারতের মাটিতে। ব্যাটারদের সামর্থ্যই যে বিশ্বকাপ জেতাবে কোনো একটি দলকে, এটা পরিষ্কার। এই ক্ষেত্রে ব্যাটিং গভীরতা বিশ্বকাপ জয়ে ভারতকে ক্রমশ ফেভারিট করে তুলছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //