বিষয় যখন তামিম ইকবাল

বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটারদের একজন তামিম ইকবাল। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু তাকে নিয়ে যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? আকস্মিক অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত, তার রেশ কাটতে না কাটতেই প্রধানমন্ত্রীর কথায় ফিরে আসা, ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে তার সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা এবং পরিশেষে ক্রিকেট বিশ্বকাপে দল থেকে বাদ পড়ায় বেশ কয়েকদিন দারুণভাবে সরগরম হয়ে উঠেছিল মাঠের বাইরের ক্রিকেট। তবে এ ঘটনাবলিতে ফুটে উঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খানিকটা অসহায়ত্ব ও দেউলিয়াপনা। একজন ক্রিকেটার ১৬ বছরেরও বেশি সময় বাংলাদেশকে তার সর্বোচ্চ সার্ভিস দেওয়ার পর তিনি অবসর নিতেই পারেন। সে ঘোষণা দেওয়ার সময় খানিকটা অভিমান থাকলেও থাকতেই পারে। তা নিয়ে এত বেশি তোলপাড় করার কি কিছু ছিল? জীবনের নিয়মে একটা সময় তো তাকে সরে দাঁড়াতেই হবে। একজন তামিম যাবেন, তার শূন্যস্থান পূরণে আসবেন আরেকজন তামিম। এটাই তো চিরন্তন নিয়ম। বিদায়কালীন সে সময়ও তো তার চোখে অশ্রু টলমল করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রিয় ক্রিকেটারের অবসরে ভক্ত-অনুরাগীদের মন খারাপ হতেই পারে। যে ক্রিকেটার বছরের পর বছর তাদের আমোদিত করেছেন, আপ্লুত করেছেন, শিহরিত করেছেন, তার অনুপস্থিতিতে এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি এনে দিতেই পারে।

বাংলাদেশে সাধারণত কেউ সময় থাকতে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারেন না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তামিম একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অনাদৃত হওয়ার আগেই ক্রিকেটানুরাগীদের হৃদয়ে সমাদৃত হয়ে তিনি সরে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি তো নিজের সক্ষমতা, মানসিক ও শারীরিক কন্ডিশন জানেন। হয়তো বুঝতে পারেন, সেই তেজ, সেই দীপ্তি, সেই মনোবল আর আগের মতো নেই। সব কিছু ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কথা তার বুকের মধ্যে অনুরণিত হতেই পারে। ৩৪ বছর বয়সী দায়িত্বশীল এ ক্রিকেটারের এমনও মনে হতে পারে, অকারণে দলের বোঝা বাড়িয়ে কী লাভ? ব্যক্তিগত সংবাদ সম্মেলনে তিনি তা স্পষ্ট করেই বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া নয়, বেশ কিছুদিন ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার পরিবারও বিষয়টি জানতেন। যে কারণে নাটকীয় একটা মুহূর্ত পেয়ে তিনি আর দ্বিধাবোধ করেননি। তা ছাড়া মানসিক একটা প্রস্তুতি তো ছিলই। তাই অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উঠে এসেছেন আলোচনার শিরোনামে। লুজ বলে বাউন্ডারি হাঁকানোর মতো পেয়ে যান মিডিয়ার ফোকাস আর অনুরাগীদের মনোযোগ ও সহানুভূতি। এ বাস্তবতাটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। হৃদয়াঙ্গম করতে পারেননি তামিমের অন্তর্গত মনোভাব। তারা এমন একটা পরিস্থিতির অবতারণা করেন, যেন তামিমকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে, যে কারণে নিজস্ব একটা তাগিদ থেকেই প্রধানমন্ত্রীকেই হাল ধরতে হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর কথায় ফেরার ঘোষণা না দিয়ে পারেননি তামিম। আপাতদৃষ্টিতে এই ফিরে আসার ক্ষেত্রে তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা পরিলক্ষিত হয়নি।

কেন যেন মনে হয়, তামিম যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে অনিচ্ছুক, সেটা তিনি হাবভাবে বুঝিয়ে দেন। যদিও কোনো কিছুই স্পষ্ট করেননি। তবে তার বডি ল্যাঙ্গুগুয়েজে অনেক না বলা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইনজুরি নিয়েও চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটি খেলা কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া অযৌক্তিক নয়। তবে তামিম বোধকরি সেদিন অনুধাবন করতে পারেন, ফুরিয়ে আসছে বেলা। ‘আনলাকি থার্টিন’কে আর লাকি করার সেই দিন বোধকরি আর নেই। এভাবে কিছুদিন খেলা গেলেও ক্রমশ সমালোচনার তীর তার দিকে ধাবিত হবে। কৌশলী ও বুদ্ধিমান ক্রিকেটার তামিম তেমন অবস্থার সম্মুখীন হতে চাননি। সুনাম ও সুখ্যাতি থাকতে থাকতেই সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন। এই সুনাম আর সুখ্যাতি তো আর একদিনে অর্জিত হয়নি। কত লড়াই আর সংগ্রাম করে কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অনেক রেকর্ড আর মাইলফলকসমৃদ্ধ টেস্ট ক্রিকেটে ৫১৩৪, ওয়ানডেতে ৮৩১৩ (আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডের ৪৪ রান যোগ করা হয়নি), টি-টোয়েন্টিতে ১৭৫৮ রান সংগ্রহ করেছেন, সেটা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে? ব্যাটসম্যান হিসেবে কোন বল কীভাবে খেলতে হয়, অধিনায়ক হিসেবে কোন কৌশল প্রয়োগ করতে হয়, সামাজিক মানুষ হিসেবে কোন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হয়, অভিজ্ঞ ও পোড়খাওয়া তামিম এটা জানেন বলেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে কালবিলম্ব করেননি। 

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণা দিয়ে উত্তপ্ত পরিবেশ থিতু করলেও তামিমের মনের ভেতর টানাপড়েন কি চলেনি? প্রকারান্তরে তা প্রশমিত করার জন্যই বোধকরি ওয়ানডের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়ে দেন। ফিরতে বাধ্য হলেও নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবেই অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে ভারমুক্ত হয়েছেন। পুরোপুরি ফিট না হওয়ার কথা বলে এশিয়া কাপ না খেলার কথা জানিয়েছেন। সম্ভবত পরিস্থিতি স্তিমিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। সবাইকে বুঝ দেওয়ার জন্য সফরকারী আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেললেও খুব একটা স্বতস্ফূর্ততা পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি বিশ্বকাপ খেলার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও তা নিয়ে কি সংশয় ছিল না? না হলে দল ঘোষণার আগেই নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যা যা বলেছেন, তাতে কেমন একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। মনস্তাত্ত্বিকরা এ থেকে তামিমের মনোভাব সম্যকভাবে অনুধাবন করতে পারবেন। সবার মন রক্ষার জন্য ব্যাট হাতে নিতে বাধ্য হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে তার সম্পর্কটা প্রকৃত অর্থেই ভেঙে যায়। সেটা জোড়া লাগানোর ব্যাপারে তিনি কতটা আগ্রহী, সেটা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচকরা তাকে নাকচ করে দেওয়ায় তার প্রকৃত মনোভাবটা বোঝার সুযোগ হলো না। 

তবে তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা নিয়ে মাতামাতি হলেও যেভাবে তিনি সরে দাঁড়ান, তা কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে, এ প্রশ্নটাও কি উঠে আসে না? তিনি ছিলেন একটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের কাণ্ডারি। দলপতি হিসেবে তার কী ভূমিকা, সেটা তো অনেক ভালো জানার কথা। আফগানিস্তানের সঙ্গে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ শেষে তিনি যেভাবে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন, তা কি একজন অধিনায়কের দায়িত্বশীল আচরণ হয়েছে? দলকে বিপদে ফেলে দিয়ে এভাবে কি দায়িত্ব পালন থেকে সরে দাঁড়ানো যায়? বাংলাদেশ যে শেষ পর্যন্ত সিরিজে হেরে যায়, এ দায়িত্ব কি তার ওপর অনেকখানি বর্তায় না? তার অভিমান থাকতে পারে, ক্ষোভ থাকতে পারে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা থাকতেই পারে। একজন অধিনায়ক হিসেবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পর তিনি কি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না? খেলতে না পারলেও সিরিজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্তত চুপচাপ থাকলেই হতো। তাতে অবশ্য তার উদ্দেশ্য সফল হতো না। তাই বলে দেশের অসম্মান তো করতে পারেন না। তিনি যা করেছেন, তা বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা খারাপ নজির হয়ে থাকবে।  

তামিম অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খায়! তাদের বুক চাপড়ানো দেখে মনে হয়, মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে। এটা হয়তো ঠিক, এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তামিমের সিদ্ধান্তটা একটা বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই বলে এত মাতম করার কী ছিল? তামিম তো আরও আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। তখন থেকেই তো বিকল্প অধিনায়ক কে হতে পারেন, তার একটা খসড়া মাথায় থাকার কথা। তা ছাড়া যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতেই পারে। সেজন্য বিকল্প চিন্তা থাকবে না? অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বড় আসরে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্ল্যান-এ, প্ল্যান-বি, প্ল্যান-সি থাকার কথা নয় কি? আদতে বিসিবির কর্মকর্তাদের এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়নি। নাকি নির্দিষ্ট ছকের বাইরে কর্মকর্তারা চিন্তাভাবনা করতে পারেন না? এমনটা যদি হয়ে থাকে, সেটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত বছর পেরিয়ে এসে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে না পারলে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেট দুয়ারে কড়া নাড়ার সময় একটা জরুরি পরিস্থিতিতে একজন অধিনায়ক ও তাকে কেন্দ্র করে দলের খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে যায়, তাহলে আরও বড় সিদ্ধান্ত নিতে কত দিন লাগবে?

তামিমকে নিয়ে জমজমাট নাটক যেন শেষ হয়েও হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের দল থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। সঙ্গত কারণে তাকে ফিরিয়ে এনে বাদ দেওয়াটা কেমন যেন হঠকারী মনে হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে তারও কিছু দায় রয়েছে। এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু বলেন, ‘তামিম ইকবালের অনেক দিন ধরেই ইনজুরির শঙ্কা। আপনারাও জানেন, তামিম ইনজুরি নিয়ে ফাইট করছিল। নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগে ফিটনেস ফিরে পেয়েছে। প্রথম ম্যাচ খেলার পর একটা অভিযোগ এসেছে। তামিমের ফিটনেসের কথা চিন্তা করে, ইনজুরি যে কনসার্ন আছে, সেটা মাথায় নিয়েই তাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা হয়নি। মেডিকেল টিম ও বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করেই তামিমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্বকাপে অনেকগুলো ম্যাচ আছে। তামিমের ইনজুরি থাকায় তাকে নিয়ে আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি।’ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম দুই ম্যাচে খেলার পর তামিম নির্বাচকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আগামী দেড় মাসের মধ্যে ১১টি ম্যাচ খেলার জন্য ফিট নন তিনি। বোধকরি তার এ অভিমতের কারণে নির্বাচকরা তাকে দলভুক্ত করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। যদিও বাদ পড়া নিয়ে মুখ খোলেন তামিম। তবে তাকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেননি। 

ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দল ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পর এক ভিডিও বার্তায় বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার কারণ সম্পর্কে তামিম বলেন, ‘বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নিষেধ করা হয়েছিল কিংবা তিনি যদি প্রথম ম্যাচে খেলেন, তাহলে তাকে ওপেনিংয়ের পরিবর্তে নিচের দিকে খেলতে বলা হয়। ক্রিকেট বোর্ডের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে সরাসরি টেলিফোন করে এসব কথা বলেছেন। এর জের ধরে তিনি বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়েছেন। বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে তার ইনজুরির যে বিষয়টা এর আগে মিডিয়াতে এসেছে তা ঠিক নয়। তিনি পাঁচ ম্যাচের বেশি খেলতে পারবেন না বলেও যে খবর এসেছে, সে বিষয়টিও ঠিক নয়।’ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৪ রান করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একটা ভালো ইনিংস খেলেছি, আমি ভালো মাইন্ডসেটে ছিলাম। হঠাৎ করে আবার এসব ধরনের কথা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। আমি ১৭ বছর ধরে এক পজিশনে ব্যাটিং করেছি, আমি জীবনে কোনোদিন তিন-চারে ব্যাটিংই করিনি, এরকম যদি হতো যে আমি তিনে ব্যাটিং করি, চারে ব্যাটিং করি, তারপরে যদি উপরে-নিচে করা হয় দ্যাট ক্যান বি অ্যাডজাস্টেবল। কিন্তু তিনে, চারে বা পাঁচে ব্যাটিং করার কোনো অভিজ্ঞতাই আমার নাই।’ প্রথম ম্যাচ খেলা থেকে বিরত থাকা বা নিচের দিকে ব্যাটিং করার বিষয়টি তিনি ভালোভাবে নেননি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। কারণ আমার বিষয়টি পছন্দ হয়নি। আমার মনে হয়েছে যে, আমাকে অনেক জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছা করে। তখন আমি বললাম যে, আপনারা একটা কাজ করেন, আপনাদের যদি এ রকম চিন্তাধারা থাকে, তাহলে আপনারা আমাকে পাঠায়েন না। আমি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চাই না। প্রতিদিন একেকটা নতুন জিনিস আপনারা আমাকে ফেস করাবেন, আমি এইটার মধ্যে থাকতে চাই না।’

তামিমের ভিডিও বার্তার বিষয়ে মুখ খোলেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা। তবে একইদিনে রেকর্ডকৃত এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যেন তামিমের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অন্তত যখন অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে খেলা শুরু করেছি, একটি জিনিস খুব ভালো করে দেখে আসছি, যে প্লেয়ারটা ভালো করছে, যে দলের জন্য অবদান রাখছে এই প্লেয়ারকে বাংলাদেশ কখনই কোনোদিনই বাদ দেয়নি। সিম্পল একটা উদাহরণ দেই। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ভাই এশিয়া কাপে ছিলেন না। হঠাৎ করে বিশ্বকাপ দলে আসলেন। একটা সিরিজ খেললেন। হয়তো ওইভাবে অবদান রাখতে পারেননি যতটা প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি তার আরও সামর্থ্য আছে। আরও ভালো করা উচিত ছিল। যে দুটি ম্যাচ খেলেছেন দুই ম্যাচেই উনার জন্য সেই সুযোগটা ছিল এবং ভালো মঞ্চ ছিল আরও ভালো কিছু করার। তার যে ডেডিকেশন ছিল, দলের প্রতি যে অবদান ছিল, দলের হয়ে খেলার যে ইচ্ছা ছিল, সবকিছু সবাই দেখতে পেরেছেন। আমার তো দায়িত্ব না পুরো দলটা নির্বাচন করার। এমনটা হলে এশিয়া কাপের একদিন পরেই এনাউন্স করে দল দিয়ে দিতে পারতাম। এটা অনেক প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেক বিষয় চিন্তা করতে হয়। অনেক কিছু চিন্তা করে দলটা গড়তে হয়।’ তামিম বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, প্রথম ম্যাচের একাদশে তাকে না রাখার কথা জানিয়েছিলেন বোর্ডের এক কর্মকর্তা। সেটি পছন্দ হয়নি তার। এ নিয়ে উত্তেজিত হয়েছিলেন বলেও জানান তামিম। সাকিবের অবশ্য দাবি, ‘তামিমকে প্রথম ম্যাচে না রাখার কোনো আলোচনাই হয়নি। এটা নিয়ে (তামিমকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে না খেলানোর) কোনো আলোচনাই হয়নি। এমন প্রশ্ন কোথা থেকে এসেছে, আমি জানি না। যদি এমন কেউ বলে থাকে, আমি নিশ্চিত এমন কেউই বলেছে যে এই দায়িত্বে আছে, এটা আগে থেকেই আলাপ করে রাখছিল যেন জানা থাকলে দুই পক্ষের জন্যই ভালো হয়। এরকম কিছু বলাতে খারাপ কিছু আছে আমি মনে করি না। এটা তো কেউ কারও খারাপের জন্য বলবে না আমি নিশ্চিত। যদি কেউ বলে থাকে দলের কথা চিন্তা করেই বলেছে যে এরকম যদি আমরা কম্বিনেশন করি, এরকম অনেক কিছুই হয় ম্যাচকে কেন্দ্র করে। আপনি এরকম কম্বিনেশন বানালে কি হতো, ওরকম কম্বিনেশন বানালে কি হয়। আমার মনে হয় না এরকম আলোচনা কোনো দোষের আছে।

ব্যাটিং অর্ডারে তামিমের নিচে খেলা প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, ‘এরকম প্রস্তাব দিলে কি কোনো দোষের কিছু আছে নাকি এরকম প্রস্তাবই দেওয়া যাবে না। দল আগে নাকি কোনো ব্যক্তি আগে? রোহিত শর্মা ওপেনিং থেকে নম্বর সেভেন পর্যন্ত খেলেছে। সে ১০ হাজার রান করে ফেলেছে। ও যদি তিন-চারে খেলে বা ব্যাটিং অর্ডারে নামে তাহলে কি খুব বেশি প্রবলেম হয়? এটা আসলে আমার কাছে মনে হয় বাচ্চা মানুষের মতো... আমার ব্যাট আমিই খেলব... আর কেউ খেলতে পারবে না। দলের প্রয়োজনে যে কারও যে কোনো জায়গায় খেলতে রাজি থাকা উচিত। দল সবার আগে। আপনি একশো করলেন দুইশো করলেন এটা কোনো পার্থক্য গড়ে দেয় না।’ সাকিবের সাক্ষাৎকারের বিষয়ে কোনো অভিমত প্রকাশ করেননি তামিম। 

তামিমের বক্তব্যে প্রকারান্তরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি তার অন্তহীন ক্ষোভ প্রকাশ পায়। কিন্তু সাকিবের বক্তব্যে তামিমের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয়, এ দুজনের বিরোধের কারণেই তামিমকে বাদ পড়তে হয়েছে। আর সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন তামিম নিজেই। ক্রিকেট বিশ্বকাপে তামিমের আর খেলার সম্ভাবনা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তিনি আর কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবেন, সেটাও একটাও ব্যাপার। তবে এ নিয়ে তাকে খুব বেশি আশাহতও মনে হচ্ছে না। এর কারণ, তিনি অনেক ভেবেচিন্তে ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেও তাকে নিয়ে যে নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়, সম্ভবত সেটাও তিনি উপভোগ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কারও ভূমিকাই ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। ক্রিকেট বিশ্বকাপের কারণে বোধকরি তামিমের দল থেকে বাদ পড়া এবং এ নিয়ে আলোচনা থেমে গেছে। বিশ্বকাপ শেষে সেটা আবার পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তা অনেকটাই নির্ভর করবে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল কেমন করে, সেটার ওপর। তবে তামিমের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //