অপরাধ জগতে শক্তিশালী অবৈধ বিদেশিরা

দেশের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিদেশিরা। দেশে বসবাসরত বিদেশির সঠিক সংখ্যা যেমন জানাতে পারে না কোনো সংস্থা; তেমনি কি পরিমাণ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তারও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। 

তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর বিষয়টি আবারো নজরে এসেছে সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, অনলাইন ও অফলাইনে অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বিদেশিদের বেশিরভাগই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এই অপরাধীরা অনলাইনে মানুষের সাথে নানা ধরনের প্রতারণা করার পাশাপাশি অর্থ পাচার, মানবপাচার এবং দেশি বিদেশি জাল মুদ্রা তৈরির সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব অপকর্মের মূল নেতৃত্বেই রয়েছে তারা।

জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানা ধরনের অপরাধ কর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে গত কয়েক মাসে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় একশ’ বিদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং গত কয়েক বছরে গ্রেফতার হওয়া বিদেশির সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

সাম্প্রতিক চিত্র

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গত দুই মাসের অভিযানে বিদেশি অপরাধ চক্রের প্রায় অর্ধশত সদস্য আটক হয় বলে জানা গেছে। সিআইডির তথ্য বলছে, তারা এই সময়ে ৪০ জন বিদেশিকে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করেছে, যাদের বেশিরভাগই নাইজেরিয়ার নাগরিক। গ্রেফতার হওয়াদের বেশিরভাগই অনলাইনে উপহার প্রতারণা চক্রের সদস্য বলে জানা গেছে। নাইজেরিয়া ছাড়াও ক্যামেরুন, কেনিয়া ও লিবিয়ার কিছু নাগরিক এই অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে জানিয়েছে সিআইডি সূত্র। 

অপরাধে জড়িত বেশিরভাগ বিদেশিই ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসার পর তাদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও দেশে অবস্থান করে এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এই ধরনের অন্তত ১০টি চক্রের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা।

রাজধানীর পল্লবী থেকে এক বাংলাদেশি ও ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি। ফাইল ছবি

এ ধরনের বড় একটি অপরাধ চক্রকে সম্প্রতি আটক করা হয়। গত ৯ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার পর উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ১৬ নাইজেরীয় ও দুই বাংলাদেশিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানী থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তাদের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা, ২৩টি মোবাইল ফোন, ১৫টি পাসপোর্ট ও বিপুল পরিমাণ টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। 

এর দুই সপ্তাহ পর, ফেসবুকে বন্ধুত্বের পর দামি উপহার দেয়ার নামে প্রতারণা করে গত কয়েক মাসে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নেয়া আরো একটি চক্রকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এই ঘটনায় রাজধানীর পল্লবী থেকে এক বাংলাদেশি নারী ও ১২ নাইজেরীয় নাগরিককে গ্রেফতার করে সিআইডি।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করীম বলেন, ‘পর্যাপ্ত পরিমাণ মনিটরিং ও সতর্কতা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে বিদেশি এসব চক্র অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের অন্য কোনো বিভাগের কাছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই যে, দেশে কি পরিমাণ বৈধ অথবা অবৈধ বিদেশি অবস্থান করছেন। এটি একটি উদ্বেগের কারণ।’

র‌্যাব-৪-এর সহকারী পরিচালক সাজিদুর রহমান বলেন, ‘শুরুর দিকে কিছু বিদেশি নাগরিক অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা ও বিদেশি মুদ্রা জালিয়াতির সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার ফলে এসব চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হয় ও এটিকে ব্যবহার করে মানব পাচারসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।’

সিআইডির সহকারী সুপারিনটেন্ডেন্ট জিসানুল হক বলেন, ‘ফুটবল খেলোয়াড়, গার্মেন্টস খাতের ক্রেতা ও টুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে বহু বিদেশি অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করা বিদেশিরা নিজেদের মধ্যে এক বা একাধিক চক্র গড়ে তুলে তার মাধ্যমে অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে।’

বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার

সরকারের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য না থাকলেও সম্প্রতি দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতি বছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রতারণার কাজে ব্যবহার কিছু ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে। ফাইল ছবি

টিআইবি বলছে, বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এদের অনেকে কর ফাঁকি দিচ্ছে আবার অনেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে কোনো কর না দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে নিজ দেশে। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।

ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য না থাকলেও, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, হোটেল ও রেস্তোরাঁর মতো খাতে বিদেশি কর্মীরা কাজ করে থাকেন। 

গবেষণা অনুযায়ী, ভিসা নীতি লঙ্ঘন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদেশি কর্মী অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে। অনেক বিদেশি নাগরিক সাধারণত টুরিস্ট ভিসা বা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তীকালে কাজ করার অনুমতি না নিয়েই চাকরিতে যোগ দেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //