ফাঁদে ফেলে ফারদিন হত্যা, ধোঁয়াশায় তদন্ত সংস্থা

চাঞ্চল্যকর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের পর দিন যতই গড়াচ্ছে রহস্য ততই ঘনীভূত হচ্ছে। এই মেধাবী ছাত্রকে কোথায় খুন করা হয়েছে? সে রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি এখনো। তদন্ত সংস্থাও স্পষ্ট নয় কিলিং স্পট সম্পর্কে। যদিও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি ঘিরে চলছে তদন্ত। কর্মকর্তারা খোলাসা করে কিছু না বললেও এতদিন আভাস মিলেছিল, ওই বস্তিতে খুন হতে পারেন পরশ।

ফারদিনকে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন ছাড়াও আরও দুই দিন চনপাড়া এলাকায় যান ফারদিন। যে ঘরে ফারদিন নৃশংসভাবে খুন হন সেই ঘরটি বস্তির ভয়ংকর এক নারীর। সেই নারীর নাম মনু (৪২)। তিনি ২০ বছর ধরে চনপাড়া বস্তির ওই ঘরে ২০-২৫ জন কিশোরী নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে পুরুষদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নেন। তাদের কবলে যে পড়েছে তাকেই হতে হয়েছে নিঃস্ব।

চাহিদামতো টাকা না দিতে পারলে সইতে হয়েছে নিপীড়ন-নির্যাতন, এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর লাশ পড়েছে শীতলক্ষ্যায়। সেদিনও মনুর দাবি করা পাঁচ লাখ টাকা দিতে না পারায় নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছে ফারদিনকে। ফারদিনের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ওই যুবকের নাম পলাশ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তাকেও ফারদিনের সঙ্গে হত্যার পর লাশ নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর নৌ-পুলিশের সদস্যরা দুই দিন পর আরও এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে।

ওই যুবকের মরদেহ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। এখনও ওই যুবকের খোঁজে কেউ আসেননি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, ওই যুবকই পলাশ। যিনি ফারদিনের সঙ্গে ঘটনার দিন মোটরসাইকেলে করে বিভিন্নস্থানে ঘুরেছেন। 

স্থানীয় ও তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এমন লোমহর্ষক ঘটনার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। 

এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শনিবার বরিশাল থেকে রায়হান ওরফে হেরোইন্সি রায়হানকে আটক করেছে র‌্যাব। আর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে নুর জামাল নামে একজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আটকের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানো হলেও তাদের তথ্যের ভিত্তিতে মনু, তার মেয়ে স্বপ্নাসহ পলাতক ৮-১০ জনকে গ্রেফতার করতে অভিযানে নেমেছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। 

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারীঘটিত কোনো বিষয় নিয়ে ফারদিনকে ফাঁদে ফেলে জিম্মি করে হত্যা করে থাকতে পারে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে মাদক সেবনের বিষয়টিও  উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। সেদিনের ঘটনায় একজন প্রত্যেক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চনপাড়া বস্তির বাসিন্দা এক তরুণ জানান, সেদিন ফারদিন ও তার সঙ্গে পলাশ নামে আরেকজন ছিলেন। তারা মনুর বাসায় গিয়ে ফাঁদে পড়েন। টাকা না পেয়ে মনু লোকজন ডাকেন। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সিটি শাহিন ও বজলু মেম্বারের লোকজন। তাদের কয়েকজনের নাম বলেছেন তিনি। তারা হলেন- উজ্জ্বল, রায়হান ওরফে হেরোনন্সি রায়হান, পিচ্চি শাহ আলম, মিঠু, টাক রবিন, ডাকাত মোস্তফার ভাগিনা মোবারক ও মালটা রনি। ওই ঘটনার সময় এরা সবাই মনুর বাসায় গিয়ে ফারদিন ও ফারদিনের সঙ্গে থাকা যুবককে মারধর করে।

তিনি জানান, মনুর চাহিদা ছিল জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা। টাকার পরিমাণ বেশি থাকায় দিতে পারবে না বলেছে ফারদিন। এরপর তাদের বেদম মারধর করা হয়। তাদের চিৎকারের শব্দ অনেকেই শুনতে পেয়েছেন। তবে ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি কেউ। যারা প্রতিবাদ করবে তাদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর এমনকি মারধর করে বস্তি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতেন সিটি শাহিন ও বজলু মেম্বারের লোকজন।

ওই তরুণ বলেন, মারপিটের সময় অনেক চিল্লাচিল্লি হওয়ায় গ্রামের লোকজন জানতে পেরেছে এবং তখন আমরা শুনতে পেয়েছি, এরকম ঘটনা ঘটছে। মনুর বাসায় মাসের পর মাস এমন ঘটনা ঘটে। তার বাসার সামনে আলামিন নামে একটি স্কুল রয়েছে এবং তার একটু দূরে নব কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় রয়েছে। মনুর বাসাটি আল আরাফা মাদরাসার সামনাসামনি। ওই বাসায় নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে ফারদিন ও তার সঙ্গীকে নির্যাতন করা হয়। আমরা পরে শুনেছি, প্রচুর মারধর করেছে তাদের। লোকগুলো বাঁচবে না, এটা শুনেছি। পরে যখন শুনেছি, শীতলক্ষ্যায় লাশ পাওয়া গেছে তখন আমরা সিওর হয়েছি।

বস্তিবাসী ওই তরুণ আরও বলেন, বস্তির লোকজন প্রথমে বুঝতে পারেনি যাদের মারধর করা হয়েছে তারা বুয়েটের ছাত্র। পরে মিডিয়ায় প্রচার হলে জানতে পেরেছে। বস্তিবাসী কানাঘুষা করছিল, বাইরের দুজন লোককে মারধর করা হয়েছে। পরে জানতে পেরেছি, তারা মারা গেছে। ভয়ে কেউ বলেওনি যে তারা মারা গেছে।

তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যায় অনেক লাশ পড়েছে। মাঝিরা ভয়ে কেউ নৌকায় সেই লাশ বহন করেনি। হত্যাকারীরা নিজেরাই নৌকা নিয়ে নদীতে লাশ ফেলে দেয়। ঘটনার এক-দুই দিন পরে আমরা খবর পেয়েছি। কিন্তু লাশ যে কই ফালাইছে তা জানি না। আশপাশের লোকজন মনুর বাসা চিনত। লোকজন নিয়ে এলে তারা অতিরিক্ত টাকা পেত। রেফারেন্স অনুসারে এলে মনুর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। মনুর এখানে ২০-২৫ জন মেয়ে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, সারুলিয়া, যাত্রাবাড়ী, বনশ্রী, রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকা থেকে মনুর বাসাসহ আরও তিনটি স্থানে পুরুষ মানুষ আসে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার প্রকৃত কারণ এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবিপ্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ফারদিনের মোবাইলের ডাটা এনালাইসিস ও বিভিন্ন জায়গায় তিনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের কোনো এক জায়াগায় খুন হয়ে থাকতে পারেন ওই তরুণ। মোবাইলের লোকেশনে আমরা নারায়ণগঞ্জও পেয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে তদন্তের স্বার্থে কংক্রিট কিছু বলতে পারছি না।

ডিবি প্রধান বলেন, আমরা কিন্তু ডিবির পক্ষ থেকে কখনো বলিনি, বুয়েটের ছাত্র ফারদিন ডেমরার চনপাড়ায় গিয়ে মাদকের কারণে মারা গেছেন। আবার মামলার আসামি ফারদিনের বন্ধুকে আমরা গ্রেফতার করেছি, তিনিই খুন করেছেন- সেটিও কিন্তু আমরা বলছি না। আমরা বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করছি। আমাদের দল সব বিষয়, তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে বিচার-বিশ্লেষণ করছে।

তিনি আরো বলেন, ফারদিন ঢাকা শহরের যেখানে যেখানে গিয়েছিলেন আমরা বিভিন্ন টেকনিক্যাল মাধ্যম ব্যবহার করে খুঁজে বের করেছি। তবে কংক্রিট কোনো তথ্য বের করতে পারিনি বলে এখনই কিছু বলছি না। কিন্তু আমাদের কাজ চলছে এবং ডিবির টিম রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে। ডিবির প্রধান আরও বলেন, বুয়েটের ছাত্র ফারদিন হত্যার রহস্য উদঘাটনের জন্য তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে সম্ভাব্য সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করছেন ডিবির তদন্ত দলের সদস্যরা।

উল্লেখ্য, রাজধানীর রামপুরা থেকে নিখোঁজের তিন দিন পর ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েটের ছাত্র ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ফারদিনের বান্ধবী বুশরা এবং অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের নামে ৯ নভেম্বর গভীর রাতে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা করেন বুয়েটছাত্রের বাবা নূর উদ্দিন রানা। ১০ নভেম্বর সকালে রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি বাসা থেকে বুশরাকে গ্রেফতার করা হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //