‘দরবেশ বাবা’ সেজে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ

দরবেশ বাবা সেজে মোবাইল কলে রাজধানীর ধনাঢ্য পরিবারের মিসেস আনোয়ারা বেগম (৫৯) নামের একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এ ছাড়া আরো দুজনের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর আজ রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) এমনই তথ্য জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সিআইডি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদুর রহমান জানান, ভুক্তভোগীদের মধ্যে মিসেস আনোয়ারা বেগম যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন, তখন প্রতিকার পাওয়ার জন্য মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন এবং অতিরিক্ত আইজিপি সিআইডি বরাবর অভিযোগ করেন। পরে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভিকটিমের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে উক্ত আসামিদের শনাক্ত করে ঢাকার উত্তরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের হোতা মো. হাসেম। তিনি প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অ্যামাউন্টের টাকা নিতেন। এরপর বড় অ্যামাউন্টের টাকা নেওয়ার সময় মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে মিসেস আনোয়ারা বেগমের নিকট পাঠাতেন এবং তানজিদ হাসান একসাথে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেতেন। এভাবে ধাপে ধাপে তারা মিসেস আনোয়ারা বেগমের নিকট থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা নেন।

তানজিদকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মো. হাসেম ভোলার বোরহানুদ্দিনে অবস্থান করছেন। পরে সিআইডির একটি টিম অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।

হাসেমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তিনি ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছেন। প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে পাশাপাশি তিনি ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রতি মাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতেন এবং পোস্ট বুস্ট করতেন। যাতে তার বিজ্ঞাপন সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এ ছাড়াও তিনি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এভাবে তিনি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সাথে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলতেন এবং তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেন। 

দরবেশ বাবারূপী প্রতারক মো. হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কণ্ঠে কথা বলতে পারেন। যেমন জিন-পরীর কণ্ঠ, ২০০ বছর বয়সী হুজুরের কণ্ঠ, ১০০ বছরের বাবার কণ্ঠ।

এই প্রতারক ফ্রান্সপ্রবাসী ইমাম হোসেন (৪০) নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে তাকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া অন্য আরেকজন ইতালিপ্রবাসীর নিকট থেকে একইভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

সিআইডি টিম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ফ্রান্সপ্রবাসী মো. ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। উক্ত প্রবাসীর বউ-বাচ্চা খেয়ে না খেয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছেন। অথচ প্রবাসে তার কষ্টে উপার্জন করা টাকায় ভণ্ড দরবেশ বাবা বাড়ি-গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। প্রবাসী ইমাম হোসেন এক পর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলেন। বড় বোন তার ছেলের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছেন।

সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারকচক্রের এ রকম ২০-২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়াতে আছে ১০-১২ জন। এর মধ্যে পাঁচ-ছয়জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছেন, যারা চার-পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ বাবারূপী প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছেন।

আসামিদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে সিআইডিতে তদন্তাধীন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //