পারিবারিক অচ্ছ্বলতার মধ্যে বড় হলেও পুলিশে চাকুরিতে যোগদানের পর কপাল খুলে যায় সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদের। নানা ভাবে তিনি নিজের পদের অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন বিশাল অবৈধ সম্পদের পাহাড়। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে সেসব সম্পদ। সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে তার নামে। তারপর থেকে জনমনে প্রশ্ন, কি করে এমন সম্পদ গড়ে তোলেন হারুন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থানার হোসেনপুর গ্রামের হতদরিদ্র মৃত আবুল হাশেমের ছেলে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। বাবা পেশায় কৃষক ছিলেন। লোকশ্রুতি রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন হারুনের বাবা আবুল হাশেম, চাচা সোলেমান (বর্তমানে শ্বশুর) এবং কুরবান আলী, বাদশা মোল্লাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগিতা করতেন। তাদের নেতৃত্বে মিঠামইন থানার জনৈক শাহেদ সাহেবের বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারিসহ আক্রমণ করে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হারুন এলাকার লোকজনের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেন। ১৯৯৩-৯৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে সালসাবিল বাসের টিকিট চেকারের চাকরি নিয়েছিলেন। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে হারুন তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বানিয়েছিলেন। সেটি ব্যবহার করেই বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের চাকরি পান। সারদায় ট্রেনিংয়ের সময় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত হন। এরপর মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ করার কারণে হারুন পুলিশের চাকরি ফিরে পান।
হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার মিঠামইনে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। আরেক ভাই মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান (জিয়া) পুলিশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এএসআই পদে চাকরি করছেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন মদের বার থেকে কয়েক কোটি টাকা মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক বলেন, ‘জিয়া এএসআই হলেও উপপরিচালকরা পর্যন্ত তাকে ভয় পান। ভাই হারুনের নাম করে জিয়া রাজধানীর বারগুলো থেকে মাসে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, হারুন যখন যেখানে চাকরি করেছেন, সেখানেই জড়িয়েছেন নানা অপকর্মে। গাজীপুরের এসপি থাকাকালে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন এমসি বাজারের পাশে তাহের অ্যান্ড সন্স ফিলিং স্টেশনের ৭ কোটি টাকার ১ বিঘা জমি একটি গ্রুপকে দখল করে দেন হারুন। এ ছাড়া গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রাকিব সরকারকে সাড়ে ১৭ শতক জমি দখল নিতে পুলিশি সহায়তা দেন হারুন। ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের মাধবপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা কফিল উদ্দিনের দুই বিঘা জমি একই কায়দায় দখলে নেওয়া হয়। গাজীপুরের ১০০ কোটি টাকা মূল্যের একখণ্ড জমি আমমোক্তারনামা জোর করে রেজিস্ট্রি করে দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগে হারুনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। গাজীপুরের দায়িত্বে থাকাকালে হারুনের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক মানুষকে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় সবার কাছ থেকেই তিনি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। যারা টাকা দেননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন।
হারুনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে অভিযোগ করেন গাজীপুরের অনেক মানুষ। তিনি কোনো প্রতিকার করতে পারেননি। পরে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করা হলে সেখানে নানা অপকর্মে জড়ান হারুন। ওই সময় ১৪ লাখ করে টাকা নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রমাণ পায় পুলিশ সদর দপ্তর। পরে ওই কনস্টেবলরা চাকরি হারালেও হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ওই সময় বেশ কয়েকজন শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল হারুনের বিরুদ্ধে। দাবি অনুযায়ী চাঁদা না পেয়ে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে, আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজের স্ত্রী-পুত্রকে তুলে নিয়ে যান হারুন। ওই ঘটনায় তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
পাওনা ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা চাইতে গিয়ে হারুনের রোষানলে পড়েন উত্তরার জাতীয় পার্টি নেতা আলমগীর কবির। জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে হারুনের দখল করা তিনটি প্লটে মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেন আলমগীর কবির। এ কাজের জন্য ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাকি রয়ে যায়। সেই টাকা চাইতে যাওয়ায় ডিবি দিয়ে আলমগীর কবিরসহ তার তিন সহযোগীকে তুলে নিয়ে যান হারুন। পাঁচ দিন ডিবি অফিসে আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এরপর কোনো টাকা পাবে না মর্মে লিখিত দেওয়ার পর আলমগীর কবির ও তার সহযোগীদের চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে পাঠানো হয়।
যোগাযোগ করা হলে হারুনের দখল প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে আলমগীর কবির বলেন, ‘৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাসায় দীর্ঘদিন সস্ত্রীক বসবাস করতেন ৭৫ বছর বয়সী এনায়েত উল্লাহ খোরাসানি। এক দিন সকালে হারুন নিজে গাড়ি নিয়ে এসে ওই প্লটটি দখল করেন। ওই সময় আমরা সঙ্গে ছিলাম। বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীকে মালপত্রসহ কাভার্ডভ্যানে তুলে সদরঘাট নিয়ে ফেলে আসা হয়।’
জানতে চাইলে ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটের প্রকৃত মালিক এনায়েত উল্লাহ খোরাসানির ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ১৯৭৮ সালে ওই প্লটটা আমার বাবা ক্রয় করেন। ওখানেই আমরা ছিলাম। পরে আমি ব্যবসায়িক কারণে পল্টনে থাকতে শুরু করি। তখন ওরা বিভিন্ন সময়ে বাসার মধ্যে ইট মারত, বিভিন্নভাবে হ্যারেজ করত। একপর্যায়ে বাবা মারা গেলে মা ওখানে একাই থাকত। একদিন রাতে স্থানীয় নাইম কমিশনার আর হারুন উপস্থিত থেকে আমার মাকে বের করে দেয়। জোর করে ওই রাতে আমার মায়ের কাছ থেকে স্টাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে প্লট লিখে নিয়ে কাভার্ডভ্যানে করে মালপত্রসহ সব রাতের মধ্যে ফেলে দেয়।
আব্দুল আলিম নামে উত্তরার আরেক বাসিন্দা বলেন, উত্তরার অধিকাংশ প্লট হারুনের দখল করা। যেই প্লটটি তার পছন্দ হতো, তার মালিককে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যেতেন। এরপর বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জমি দখল করতেন।
ডিজে সানি নামে থাইল্যান্ড প্রবাসী এক ব্যক্তি বলেন, আমাকে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে হারুন ২০ লাখ টাকা চায়। পরে আমি মামলার ভয়ে ১০ লাখ টাকা দিই। আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েও আমার বিরুদ্ধে এক নারীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দেওয়ায়। সেই মামলায় আমি ২১ দিন জেল খেটেছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের ব্যক্তিগত নম্বরে টানা কয়েক দিন বারবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তার কথিত মামা জাহাঙ্গীরের মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে। গত শনিবার উত্তরার জাহাঙ্গীরের অফিস ও বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাসার নিরাপত্তাকর্মী ইফাতুল বলেন, জাহাঙ্গীর সাহেব এখানে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দুই সপ্তাহ ধরে স্যার এখানে আসেন না। তার পরিবারের কেউ এখানে এখন নেই।
সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার যে বৈধ আয়, তার সঙ্গে সম্পদের পরিমাণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। দেশে-বিদেশে তিনি যে সম্পদ অর্জন করেছেন, সেটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে তার কাছে যে ক্ষমতা ছিল, সেটির অপব্যবহার করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আইন লঙ্ঘন করে তাদের সংবিধানপরিপন্থি অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সেটি ব্যবহার করেই তিনি এই সম্পদ গড়েছেন। আর এই সম্পত্তি যে তিনি একা করেছেন, সেটা কিন্তু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তার সঙ্গে অনেক যোগসাজশকারী ও সহায়তাকারী রয়েছে। এখন এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার এবং জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ডিবি হারুন অবৈধ সম্পদ পুলিশ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh