হাসিনা পরবর্তী ৬ মাসে ‘অপরাধে ডুবে’ বাংলাদেশ

মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে ছিনতাই, হামলা এবং ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। যে পরিবর্তনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল তরুণেরা, তারা আজ নিজেদেরকেই প্রশ্ন করছে: এ আন্দোলন তারা কীসের জন্য করেছিল?


মায়দুল হাসান যখন প্রথম ছিনতাইয়ের শিকার হন, তখন তিনি ভেবেছিলেন এর চেয়ে খারাপ আর কিছু ঘটতে পারে না। কিন্তু এক সপ্তাহের যেতে না যেতেই ২১ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আবার মারধর ও ছিনতাইয়ের শিকার হন। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে পুলিশের সামনে।


মায়দুল জানান, পুলিশেরা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল এবং কিছুই করেনি।


গত বছর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই মায়দুল হাসান। এ আন্দোলনের ফলেই দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। অথচ এখন মায়দুল ভাবছেন, তিনি যে জাতির জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন তার পরিণত কী হয়েছে?


“এর বিনিময়ে আজ আমি এটাই পেলাম! জাতি অপরাধে ডুবে যাচ্ছে, কেউই যেন খেয়াল করার নেই”, বলেন তিনি।


১৩ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০টার দিকে রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি আইটি ফার্মে তার খণ্ডকালীন চাকরি থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদল লোক তার ওপর অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীরা তার পিক্সেল ফোর-এক্সএল ফোন, মানিব্যাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড ও হেডফোন কেড়ে নেয়।


কয়েকদিন পর, ১৮ ফেব্রুয়ারি, তার ওপর আবার হামলা করা হয়। এবার তিনি ছিনতাইয়ের পাশাপাশি মারধরেরও শিকার হন। হামলাকারীরা তার নতুন গুগল পিক্সেল ৭ ফোনটি ছিনিয়ে নেয়।


এই ফোনটি মায়দুল ৪০০ ডলার ধার করে কিনেছিলেন। যখন তিনি ফোনটি ফেরত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, তখন হামলাকারীরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।


মায়দুল বলেন, “পুলিশ মাত্র কয়েক মিটার দূরে দাঁড়িয়েছিল। আমি কেঁদেছি, অনুনয়-বিনয় করেছি, কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।"


পরে তিনি নিকটবর্তী থানায় অভিযোগ করার চেষ্টা করলে স্থানীয় এক ব্যক্তি নিজেকে বিএনপি অনুসারী ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য দাবি করে থানায় অভিযোগ করতে নিষেধ করেন।


সেই ব্যক্তি মায়দুলকে আশ্বস্ত করে থানার বাইরে নিয়ে যায এবং ফোন ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে টাকা দাবি করেন।


ফোন ফেরত পাবার আশায় দিশেহারা মায়দুল কাছের একটি এটিএম থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা তুলে লোকটিকে দেন। তবে তিনি যে প্রতারিত হয়েছেন, সেটি বুঝতে পারেন দ্রুতই। পরে সে এও জানতে পারেন লোকটি একসময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগে সঙ্গে জড়িত ছিলেন।


এটি একটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জ্বলন্ত উদাহরণ। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকার জন্য পরাজিত দলগুলোর সদস্যরা রাতারাতি আনুগত্য পাল্টে ফেলেন।


মায়দুল অবশেষে অনলাইনে একটি অভিযোগ জমা দেন পুলিশের কাছে, যার একটি কপি তিনি আল জাজিরাকে দেখিয়েছেন। কিন্তু এরপরও কোনো পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।


ফেসবুক মায়দুলের পোস্ট রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে তিনি লেখেন, "আমি এমন একটি দেশে বাস করি, যেখানে একজন ভুক্তভোগী হয়েও, আমাকে থানায় হয়রানির শিকার হতে হয়। অপরাধীরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, অফিসারদের সামনে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে, আর পুলিশ কিছুই করে না। আমি তাদের সামনে অনুনয়-বিনয় করেই গেছি আর তারা শুধু তা তাকিয়ে দেখেছে।"


মায়দুল অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি থানায়। সেখানকার ওসি আলী আহমেদ মাসুদ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, অভিযোগ জমা দিতে কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি।


“আমার ধারণা ফোনটি ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়ে থাকতে পারে, যে কারণে তিনি প্রথমে ডায়েরি না করার সিদ্ধান্ত নেন।”


পরে মামলা হয় এবং ফোনটি উদ্ধার এবং ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করার দাবিও করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।


মায়দুলের হামলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা হস্তক্ষেপ না করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগের বিষয়ে ওসি মাসুদ কোনও মন্তব্য করেননি।


"এখনও আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। তবে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।"


নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন খাদের কিনারে


মায়দুলের সঙ্গে যা ঘটেছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৭ কোটি মানুষের আবাসস্থল বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতির এত অবনতি আর দেখা যায়নি স্মরণকালে।


শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই, রাস্তাঘাট ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। শুধুমাত্র ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই দেশজুড়ে ২৪২টি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা রিপোর্ট করেছে পুলিশ বাহিনী - যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।


২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কমপক্ষে ২৯৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গত বছরের একই মাসে ২৩১টি খুনের ঘটনা ঘটে।


বিগত বছরের বিচারে ডাকাতি ১১৪ থেকে বেড়ে ১৭১টিতে পৌঁছেছে এবং অপহরণের ঘটনা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।


পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে ছিনতাই, ডাকাতি এবং অপহরণ বেড়েছে, যা আগের পাঁচ বছরের একই সময়ের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুস সাকিব বলেন, "এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। মানুষ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল, কিন্তু এখন তারা তাদের ঘরের বাইরে পা রাখতে ভয় পাচ্ছে। এটি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবস্থা সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না।”


তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এই উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছেন যে সরকার এই ক্রমবর্ধমান অপরাধ রোধে যথাযথভাবে কাজ করে চলেছে।


ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টা পরে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টায় এক ‘জরুরি’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আপনারা আজ রাতে থেকেই লক্ষ্য করবেন যে আমাদের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।” ‘এত খারাপ পরিস্থিতি কখনও দেখিনি’


আনোয়ার হোসেন নামে একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে থেকে প্রায় ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আক্রমণ করা হয়। মোটরসাইকেল আরোহীসহ ছয় ব্যক্তি তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।


প্রতিরোধ করলে তারা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। উভয় পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনোয়ার হোসেন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।


ভিডিওতে ধারণ করা এই ঘটনাটি ভাইরাল হলে ঢাকা জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে।


১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে, স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশব্যাপী খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজিসহ কয়েক ডজন সহিংস অপরাধের খবর প্রকাশ হয়। বিভিন্ন অপরাধের ভয়াবহ ভিডিও এবং ভুক্তভোগীদের সরাসরি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।


পঞ্চাশোর্ধ রিক্সাচালক রহমত উল্লাহ তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “আগে চুরি ও ছিনতাই হতো, কিন্তু এখন তা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।"


১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এত খারাপ পরিস্থিতি কখনও দেখেননি তিনি। এমনকি তার যাত্রীরাও হামলার শিকার হয়েছেন।


"আমি আগে ১৫/২০ দিনের আয় জমা করে ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়িতে পাঠাতাম। এখন প্রতিদিন যা আয় করি, তা তাৎক্ষণিকভাবে (মোবাইল ব্যাংকিংয়ে) বাড়িতে পাঠাই।"


পরিস্থিতির এত অবনতি সত্ত্বেও সরকারকে সংকট স্বীকার করতে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যাচ্ছে।


আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সরকারের ত্রুটি স্বীকার করলেও জোর দিয়ে বলেছেন যে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে প্রশাসন পরিস্থিতি উন্নয়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।


তিনি বলেন, “কখনও পরিস্থিতি ভালো, আবার কখনও অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”


তবে অনেক বাংলাদেশিই মনে করেন এটি শুধুই মিথ্যা আশ্বাস।


বিশেষ করে দেশজুড়ে ধর্ষণের খবরের পর বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়।


এই ধর্ষণগুলির মধ্যে কমপক্ষে ১০টি ঘটনার সত্যতা আল জাজিরা যাচাই করে দেখেছে।


বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার তাৎক্ষণিক পদত্যাগ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি মোকাবেলায় জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়।


বিক্ষোভকারীদের একজন ইতি আক্তার আল জাজিরাকে বলেন, "আমি যখনই বাইরে বের হই, আমার বাবা-মা চিন্তিত হন, আর আমার মতো সব নারীর জন্য এখন এটাই বাস্তব। আমরা কেবল আমাদের দৈনন্দিন কাজ শেষে ধর্ষিত বা অপহরণের শিকার না হয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চাই। জীবনে আগে কখনও এত অরক্ষিত বোধ করিনি।"


আরেক বিক্ষোভকারী তানভীর রিফাত বলেন, “শেখ হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ‘গুন্ডাদের’ দেখলে এমন নিরাপত্তাহীনতা বোধ হতো। এখন আওয়ামী লীগ চলে গেছে, কিন্তু অপরাধ কেবল বেড়েই চলেছে।”


গণঅভ্যুত্থানের পর যে বাংলাদেশের আশা করেছিলেন, এটি সেই বাংলাদেশ নয়- মূল্যায়ন করে এই তরুণী বলেন, “মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হতে পারে।"


ঢাকার রাস্তাকে ডিসি ইউনিভার্সের কাল্পনিক অপরাধের নগরী গথামের সাথে তুলনা করে তানভীর বলেন, “কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের কোনো ব্যাটম্যান নেই।”


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশ্লেষক তাওহিদুল হক বলেন, অপরাধ পরিস্থিতির উন্নতির অন্যতম প্রধান সূচক হলো মানুষ ঘরে, বাইরে এবং যাতায়াতের সময় নিরাপদ বোধ করে কি না। "মানুষ এখন আর নিরাপদ বোধ করে না"


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারিসা নুসরাত এখন রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা এড়িয়ে চলেন।


তিনি বলেন, “আমার বাবা-মা আর রাত করে বাইরে থাকতে দেন না। আমি বাইরে থাকলে বাবা-মা আমাকে ফোন করতেই থাকেন।"


বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে রমজান মাসে অনলাইন ক্লাসের দাবি জানিয়েছে


পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার


গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে সামরিক ও পুলিশের একটি যৌথ অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু ৯ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার করা হলেও সহিংস অপরাধ অব্যাহত রয়েছে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশ্বার হাসান বিশ্বাস করেন যে অন্তর্বর্তী সরকার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।


তিনি বলেন, "নির্বাচিত সরকারের একক 'চেইন অব কমান্ড'-এর পরিবর্তে, বর্তমান প্রশাসনে বিভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রাধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে।


"যদিও অপরাধ দমনে তাদের ইচ্ছার অভাব নেই, তবুও তাদের তা করার ক্ষমতা সীমিত।"


গত ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলনের পর, পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করে।


যদিও ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মায়দুল হাসান বলেন, "আমরা যদি রাস্তায় নিরাপদ বোধ না করি তবে গ্রেপ্তারের কোনও অর্থ হয় না।”


নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক বাড়লে কিছু এলাকায় সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে।


বিভিন্ন পাড়ায়, স্থানীয়দের আত্মরক্ষার জন্য টহল দল গঠন করতে দেখা গেছে, ছিনতাইকারীদের তাড়াতে লাঠি হাতে টহল দিতে দেখা যায়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিনতাইয়ের অভিযোগে সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে ঢাকার একটি ফুটব্রিজ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একই রাতে, আরেকজন সন্দেহভাজন ছিনতাইকারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাওহিদুল হক বলেন, “মানুষ যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে তখন এমনটাই ঘটে, তারা নজরদারিমূলক বিচারের আশ্রয় নেয়।"


মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই দেশজুড়ে জনতার সহিংসতায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন।


অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাকিব বলেন, "হঠাৎ ক্ষমতার পরিবর্তন অস্থিরতা এবং ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করে - এটি এমন একটি পরিবেশ যেখান অপরাধীরা সহজেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অপরাধীরা এই অস্থিরতাকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে, ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা চরমে পৌঁছেছে।"


প্রধান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা 'বাংলাদেশ পুলিশ' জনসাধারণের আস্থা ফিরে পেতে হিমশিম খাচ্ছে বলে মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, "হাসিনার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বিক্ষোভের সময়, পুলিশকে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা হয়েছিল। 'নৈতিক কর্তৃত্ব' হারানোর ফলে তাদের কার্যকরভাবে কাজ করার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে।"


আগস্টে হাসিনাকে অপসারণের পর থেকে, ইউনূস সরকার বাংলাদেশের ৫০টি থানার প্রধানকে হাসিনার দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে সরিয়ে দিয়েছে।


সাকিব বলেন, "নতুন অফিসাররা তাদের নির্ধারিত এলাকা সম্পর্কে পরিচিত নন। তাদের তথ্যদাতার অভাব রয়েছে এবং অপরাধ দমনের জন্য একটি সর্বাত্মক কৌশল তৈরি করার জন্য যথেষ্ট সময়ও তারা পাননি।"


"এই সবকিছুই এমন একটি শূন্যতা তৈরি করেছে যা অপরাধীরা কাজে লাগাচ্ছে", বলেন তিনি।


ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের জামিনে মুক্তি- যাদের মধ্যে কয়েকজনকে একসময় ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে যে এই ব্যক্তিদের অনেকেই অপরাধে ফিরে এসেছে, পুরনো চাঁদাবাজি চক্র এবং বিভিন্ন অপরাধী গ্যাং-এর কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করেছে।"


"আমরা জামিন বাতিলের জন্য আপিল করার পরিকল্পনা করছি, কিন্তু সমস্যা হলো, এই অপরাধীদের অনেককেই বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের প্রভাবে জামিন দেওয়া হয়েছে”, বলেন তিনি।


দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের গণ জামিন অত্যন্ত দ্রুত করা হয়েছে মত দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “তা জনমানুষের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেয়। যদিও এটি একটি বিচারিক বিষয়, সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের যে দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয়েছে তা উদ্বেগজনক। এই ব্যক্তিদের আবার সমাজে চলতে দেওয়ার আগে জননিরাপত্তার বিষয়টি মনোযোগের সঙ্গে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল।”


রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রগুলোও অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, যার ফলে সশস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। মুখোশধারী দলগুলির অস্ত্রধারী ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে অনেক বেশি কার্যকর।


তিনি বলেন, "জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারের শক্তি এবং বৈধতা অনেক বেশি হবে।"


অন্তর্বর্তী সরকার এখনও নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করেনি। তবে ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ২৪ ফেব্রুয়ারি জানান যে, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।


কিন্তু অনেক তরুণ বাংলাদেশির কাছে এই নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।


আন্দোলনকারী রিফাত বলেন, “গত বছর আমরা একটি নিরাপদ বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায় রাস্তায় নেমেছিলাম যেখানে রাষ্ট্র জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করবে, অথচ এখন আমরা অপরাধীদের দয়ায় বেঁচে আছি।


“এমনও হতে পারে এই অপরাধীরা যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আজ আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে তারাই অদূর ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবে।"


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh