বিলুপ্তির পথে রেংমিটচা ভাষা

বান্দরবানে দুর্গম পাহাড়ে ম্রো জনগোষ্ঠীর এক গোত্র রয়েছে, যাদের নিজের ভাষা বলতে জানে এমন সদস্য সংখ্যা মাত্র ছয়জন। তাদের অধিকাংশের বয়সও ষাটোর্ধ্ব। আর সেই ছয়জন মারা যাওয়ার সাথে সাথে দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে একটি ভাষা। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা এই ভাষার নাম রেংমিটচা। 

ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো জানান, ‘আমেরিকার এক ভাষা গবেষকের মাধ্যমে জানতে পারি, আলীকদম উপজেলার কিছু দুর্গম এলাকায় আমাদের ম্রো জনগোষ্ঠীর এক গোত্র রয়েছে, যাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তারা কথা বলেন ভিন্ন সুরে। তখন ওই ভাষা গবেষকের সাথে আমি কাজ শুরু করি। রেংমিটচা ভাষাভাষী মানুষদের খুঁজে বের করি। ২০১৩ সালেও কয়েকটি পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২২ জনের রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোকজন পাওয়া যায়। আট বছরের ব্যবধানে এখন সে সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ছয়জনে। বাকিরা ইতিমধ্যে মারা গেছেন।’

তিনি আরো জানান, “বর্তমানে জীবিত ছয়জনের সবাই একই পাড়ায় থাকেন না। দুই উপজেলায় চার পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তারা। এর আগে ‘রেংমিটচা’ নামে একটি গোত্রের কথা জানলেও, তাদের ভাষা যে আলাদা ও সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের সেটি আমাদের জানা ছিল না। তবে রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোকজন ম্রোদের সাথে মূল স্রোতে মিশে যাওয়ায় তাদের সবাই এখন ম্রো ভাষায় কথা বলেন। ছয়জন ছাড়া এ ভাষা আর কেউ জানে না। ছেলেমেয়ে কেউ হয়তো বুঝতে পারবে; কিন্তু জবাব দিতে পারবে না।”

ইয়াংঙান আরো বলেন, ‘রেংমটিচা ও ম্রো ভাষার মধ্যে মাত্র দশ ভাগ মিল আছে। এর নব্বই ভাগ একেবারে অমিল। তারা যখন কথা বলে ম্রোরা কেউ বুঝতে পারে না। ম্রোদের সাথে মিশে যাওয়ায় তাদের সবাই ম্রো ভাষা বলতে পারে।’


সাম্প্রতিক দেশকালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আলীকদম উপজেলায় একটি রেংমিটচা পাড়ায় যাওয়া হয়। উপজেলা সদর থেকে তৈন খাল হয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো পায়ে হাঁটার পথ- ওই পাড়ার নাম ক্রাংসি পাড়া। পাড়াপ্রধান কারবারি তিনওয়াই ম্রোর সাথে এই প্রতিনিধির কথা হয়। তিনি জানান, এ পাড়ার বয়স আনুমানিক ৩০০ বছরেরও বেশি হবে। একসময় পাড়ার সবাই রেংমিটচা পরিবার ছিল। পরে অনেকে বার্মা ও ভারতে চলে যায়। কেউ আলীকদমের অন্য জায়গায় চলে যায়। কেউ কেউ মারা গেছেন। এসব কারণে রেংমিটচা ভাষাভাষীর মানুষ কমে যায়। বর্তমানে এই পাড়ায় ২২টি পরিবারের মধ্যে সাতটি রেংমিটচা পরিবার রয়েছে। তবে মাত্র তিনজন ছাড়া অন্যদের কেউ এ ভাষায় কথা বলতে জানেন না।

ওই পাড়ার বাসিন্দা সিংরা ম্রো জানান, তিনি একটি রেংমিটচা পরিবারের সদস্য; কিন্তু ওই ভাষায় কথা বলতে জানেন না। সহজ কিছু কথা বুঝতে পারেন মাত্র। তবে তার বাবা রেংমিটচা ভাষা এখনো ভালো করে বলতে পারেন বলে জানান। রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতে পারে এমনছয় জনের তালিকাও দেন তিনি। তারা হলেন- ক্রাংসি পাড়ার বাসিন্দা ও  তার বাবা মাংপুং ম্রো (৬৭), কোনরাও ম্রো (৭০) ও কোনরাও ম্রো (৬০), নোয়াপাড়া ইউনিয়নে মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৫) এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুং ম্রো (৬৫) ও সাংপ্ল পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৩)। তাদের মধ্যে কোনরাও ম্রো নামে দু’জন নারী ও বাকি চারজনই পুরুষ। একজন বাদে সবার বয়স ষাটোর্ধ্ব। 

মাংপুং ম্রো জানান, তার ১০-১২ বছর বয়সে পাঁচটি রেংমিটচা পাড়া ছিল। তখন একেকটি পাড়ায় ৫০-৬০টি পরিবার ছিল। বাইরে থেকে কেউ পাড়ায় এলে তাদের ওই সময় রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতে হতো। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কেউ কেউ বার্মায়, কেউ ভারতে চলে যায়। বাকিরা ম্রো জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতের সাথে মিশে যায়। এভাবে দিন দিন আমাদের সংখ্যা কমতে থাকে।’

নিজের মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গে মাংপুং ম্রো জানান, ‘রেংমিটচা ভাষায় কথা বললে, ম্রোদের অনেকেই হাসাহাসি করত। আমাদের ছেলেমেয়েরাও সংকোচবোধ করত। রেংমিটচা ভাষায় আর কথা বলতে চাইত না। পরবর্তীকালে এ ভাষায় কথা না বলতে বলতে সবাই নিজের ভাষা ভুলে যেতে শুরু করে।’ এ ভাষায় কোনো গান অথবা সঙ্গীত রয়েছে কি-না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত এ ভাষায় কোনো গান শুনিনি। দাদা-দাদির কারও মুখে কোনো গান গাইতেও দেখিনি।’ তবে ছন্দ মিলিয়ে কয়েকটি খেলাধুলার কথা শোনান তিনি।

এ পাড়ার বাসিন্দা আরেক রেংমিটচাভাষী কোনরাও ম্রো জানান, তার দুই মেয়ে, এক ছেলে রয়েছে। তাদের কেউ রেংমিটচা ভাষা বলতে পারে না। তিনি আরো বলেন, ‘এখন ঘরেও নিজের ভাষায় কথা বলার কেউ নেই। বাইরে ম্রো ভাষা বলতে বলতে রেংমিটচা ভাষা বলার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না। নিজের ভাষায় কিছু বলতে চাইলেও এ ভাষায় জবাব দেয়ার কেউ নেই। তার জন্য মাঝে মাঝে দুঃখ হয়।’ 

দুই রেংমিটচাভাষীর আকুতি, ‘মাঝে মাঝে রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতে চাই আমরা; কিন্তু অপরজনের কাছ থেকে তো আমাদের ভাষায় উত্তর আসে না। তখন খুব খারাপ লাগে। একাকীত্ববোধ করি; কিন্তু নিজেদের ভাষায় কথা বলে বেঁচে থাকতে চাই আমরা। নতুন প্রজন্ম এ ভাষায় আর কথা বলতে পারে না। জানেই না। এত কম ভাষার মানুষ নিয়ে কী পদক্ষেপ নিলে আমাদের রেংমিটচা ভাষা সংরক্ষিত হবে, আমাদের জানা নেই।’

তবে রেংমিটচাভাষীদের আলাদা জনগোষ্ঠী বলে মনে করেন ম্রোদের আরেক লেখক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংইয়ং ম্রো। তিনি জানান, তাদের ভাষা ছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ম্রোদের সঙ্গে মিল রয়েছে। যার কারণে ম্রোদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মিশে গেছে। ফলে তারা নিজেদের ভাষা ভুলে গেছে। বলতে গেলে তারা এখন ম্রো হয়ে গেছে। তারা এখন রেংমিটচা ভাষায় কথা বলে না, ম্রো ভাষায় বলে। অনেক সময় নিজের ভাষা যেটুকু পারে, সেটিও পর্যন্ত বলতে চায় না সংকোচের কারণে।

জনসংখ্যার দিক দিয়ে খুবই কম এমন একটি ভাষা সংরক্ষণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিংইয়ং ম্রো বলেন, ‘রেংমিটচা যেহেতু একটি ভাষা, এ ভাষা সংরক্ষণের ব্যাপারে আগে কয়েকবার মিটিং করা হয়েছে। তাদেরও ডেকেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তারা নিজেরাও এ ব্যাপারে আর আগ্রহী না। নিজের ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দিয়ে ও তাদের রেংমিটচা পরিবার সাথে বিবাহের ব্যবস্থা করলে কিছুটা সংরক্ষিত হবে।’

এ বিষয়ে জানতে রেংমিটচা ভাষার গবেষক ও আমেরিকার ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসনের সাথে যোগাযোগ করা হলে এক ই-মেইল বার্তায় তিনি জানান, ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে ৬০ এর দশকে প্রকাশিত বিখ্যাত জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স লুফলার তার গবেষণা গ্রন্থ ‘দ্য ম্রো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, আলীকদমের তৈন মৌজার অধীন ‘রেংমিটচা’ নামে একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ভাষা আলাদা ও স্বতন্ত্র; কিন্তু তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে ম্রোদের সাথে মিল রয়েছে।

এ গবেষক আরো বলেন, ‘১৯৯৯ সাল থেকে বান্দরবানে খুমী, ম্রো ও রেংমিটচা ভাষা নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করি। অনেকে মনে করেছিল রেংমিটচা ম্রোদের একটি উপভাষা; কিন্তু গবেষণা করে দেখেছি- এটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও আলাদা একটি ভাষা। আলীকদমে গিয়ে রেংমিটচা ভাষাভাষীদের সাথে কাজ করেছি। দীর্ঘদিন তাদের সাথে মিশে দেখেছি, জীবন জীবিকা ও সামাজিক বিশ্বাস ম্রোদের কাছাকাছি; কিন্তু ভাষাগত দিক দিয়ে একেবারেই ভিন্ন।’

তবে রেংমিটচা ভাষা খুমী, ম্রো, লুসাই, বম, খিয়াং ও পাংখোয়া ভাষার মতোই তিব্বতীয়-কুকি-চীনা ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত জানিয়ে ডেভিড বলেন, ‘মিয়ানমারের আরাকান ও চিন রাজ্যে এ ভাষা থাকতে পারে; কিন্তু গবেষণা করে আমি খুঁজে পায়নি। রেংমিটচা বাস্তবে বাংলাদেশেই পাওয়া গেছে।’

এ ভাষা সংরক্ষণের ব্যাপারে অধ্যাপক ডেভিড বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষা সংরক্ষণের জন্য যতটুকু সম্ভব তাদের কথা রেকর্ডিং করে রাখা দরকার। এ নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া দরকার। এছাড়া নতুন প্রজন্ম ও তাদের ছেলেমেয়েদের এ ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেয়া উচিত।’ 

তারা বেঁচে থাকতে এটিই রেংমিটচা ভাষা সংরক্ষণের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //