তিমিরাও গান গায়

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশাল এই প্রাণীর জীবনাচরণ আজও মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এমনই এক নতুন বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে সমুদ্রের স্মার্ট এই প্রাণীটি। এরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কিংবা সঙ্গী খুঁজতে এক ধরনের শব্দ করে, যা তিমি সংগীত হিসেবে পরিচিত। 

নাবিকরা প্রায়ই সমুদ্রের মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত ও ভীতিকর শব্দ শুনতে পান। অনেক নাবিক এই শব্দকে ভূতের গান বলে মনে করতেন। তবে গবেষকরা আগেই জানিয়েছেন, সেই অদ্ভুত ও ভীতিকর শব্দগুলোই আসলে তিমিদের গান।

বেশ কয়েক বছর আগেই সমুদ্রে দানবাকৃতির বালিন তিমিদের রহস্যময় গান রেকর্ড করেন বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা হয়, এর মাধ্যমেই তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে সমুদ্রের নিচে তিমিরা কীভাবে শব্দ করে কিংবা গান গায় তা বরাবরই এক রহস্য হয়েছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। সমুদ্রের নিচে মুখে পানি না ঢুকিয়ে কীভাবে শব্দ করা সম্ভব, সেই রহস্যের অবশেষে কিনারা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের একদল গবেষক বালিন প্রজাতির ১৪ ধরনের তিমি নিয়ে গবেষণা করেছেন। নতুন গবেষণায় বিশ্বের বৃহত্তম স্তন্যপায়ী প্রাণীর যোগাযোগের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। গবেষকদের দাবি, এ ধরনের তিমির শরীরে বিশেষ এক ধরনের ‘ভয়েস বক্স’ বা স্বর তৈরির স্থান থাকে। তিমি এই স্বরযন্ত্র বা ভয়েস বক্সের মাধ্যমে পানির নিচে গানের মতো শব্দ তৈরি করে। এই শব্দ দিয়ে তিমি সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। নতুন এই গবেষণায় দেখা গেছে, এরা পানির নিচে যোগাযোগের জন্য ৩০০ হার্জ পর্যন্ত স্বল্প-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ব্যবহার করে। এই মাত্রার আওয়াজ সমুদ্রে অপেক্ষাকৃত কম দ্রুত শোষিত হয়।  

এ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের গবেষকরা হ্যাম্পব্যাক তিমির রেকর্ডকৃত শব্দ বিশ্লেষণ করেছেন এবং এই শব্দ তৈরি করতে স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে কীভাবে বায়ু প্রবাহিত হয় তা উদ্ঘাটন করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, তিমিগুলোর ষড়যন্ত্রে একটি বৃহৎ ইউ (ট) আকৃতির কাঠামো আছে, যা লম্বা সিলিন্ডার আকৃতির টিস্যু দিয়ে গঠিত। আর এই কাঠামো শুধু বালিন তিমিদের মধ্যেই আছে। এর মাধ্যমেই তারা সমুদ্রের নিচে কম-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ উৎপন্ন করে। 

হ্যাম্পব্যাক তিমি অন্যান্য প্রাণীর মতো শ্বাসনালি দিয়ে শব্দ করে না। তাদের শ্বাসনালি ও ভোকাল কর্ডের কোনো ব্যবহার নেই। বরং এরা নাসারন্ধ্রের ভেতর থেকে বাতাস বের করে গভীর সুরেলা গান তৈরি করে। একেকটি গান দীর্ঘ হতে পারে ১০ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত এবং তারা একটানা কয়েক ঘণ্টা ধরে গাইতে পারে।

তাদের গানের বিভিন্ন রকম প্যাটার্ন থাকে, যেমন : উচ্চ সুর, নিচু সুর, আবার কখনোবা লয় পরিবর্তন হয়। এই প্যাটার্নগুলোর মাধ্যমে তিমিরা নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় এবং সঙ্গীকে আকর্ষণ করে।

গবেষণায় জানা গেছে, হ্যাম্পব্যাক তিমিরা মূলত প্রজননের মৌসুমে গান গায়। গ্রীষ্মকালে যখন তারা খাদ্যের সন্ধানে থাকে, তখন গান গাওয়ার হার কমে যায়। তবে শীতকালে যখন তাদের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়, তখন পুরুষ তিমিরা নিয়মিতভাবে গান গায়। এই গান তাদের জন্য সঙ্গী খোঁজার মাধ্যম।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তিমিরা গানের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য ও শারীরিক অবস্থার প্রমাণ দেয়। এই গান পুরুষ তিমিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ায় এবং নারীরা শক্তিশালী সঙ্গী বেছে নিতে পারে।

তিমির গানের সুরেলা ধ্বনি সমুদ্রের অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছায়। সমুদ্রের গভীর পানিতে শব্দ দ্রুত চলাচল করে, তাই এদের গান কয়েকশ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। গানের শব্দতরঙ্গ নারীদের আকর্ষণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রতিযোগিতায় যারা জেতে, তারাই সবচেয়ে বেশি সফলভাবে সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে পারে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, প্রতিটি অঞ্চলের হ্যাম্পব্যাক তিমিদের গান ভিন্ন ভিন্ন হয়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের গানের ধরন পরিবর্তন করে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়, তিমিরা প্রতি দু-তিন বছরে একবার নতুন গান শিখতে পারে। এই গানগুলো মহাসাগরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইঙ্গিত দেয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হ্যাম্পব্যাক তিমিরা গানের মাধ্যমে শুধু সঙ্গীই খোঁজে না, বরং তাদের নিজস্ব সমাজে যোগাযোগ রক্ষা করে। গবেষণা থেকে জানা গেছে, পুরুষ তিমিরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের গানের নোট পরিবর্তন করে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

হ্যাম্পব্যাক তিমির গানের ওপর গবেষণা প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। এ সময়ে গবেষকরা প্রথম বুঝতে পারেন যে তিমিরা শুধু শব্দ তৈরি করে না, বরং সুরেলা ধ্বনি বা গান গায়। মার্কিন জীববিজ্ঞানী এবং মেরিন বায়োলজিস্ট রজার পেইন ও তার দল হ্যাম্পব্যাক তিমির গানের রহস্য উন্মোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি ও তার সহকর্মীরা প্রথমবারের মতো এই তিমির গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন। তার গবেষণায় উঠে আসে যে তিমিরা গানের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে এবং এই গানগুলো প্রজনন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

রজার পেইনের স্ত্রী ক্যাটারিন পেইন ১৯৮০-এর দশকে তিমির গানের ওপর একটি বিস্তৃত গবেষণা চালান। তিনি দেখিয়েছেন, তিমিরা শুধু গান গায় না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের গান পরিবর্তন করে। তিনি আবিষ্কার করেন যে তিমিরা ‘শেখা’ ও ‘বিনিময়’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গানের নোট আপডেট করে।

২০১৫ সালে স্কটিশ গবেষক এডুয়ার্ড ডায়ল ও এলেন গার্লান্ডের গবেষণা থেকে জানা যায়, তিমিরা কয়েক বছর পর পর নিজেদের গানের ধরন পরিবর্তন করে এবং এই পরিবর্তনগুলো মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলের তিমিরা একে অপরের গানের প্যাটার্ন থেকে শিখে নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় তৈরি করে।

মজার বিষয় হচ্ছে, তিমিরা যোগাযোগ ছাড়াও শিকার করতে গান ব্যবহার করে। তবে এরা ঠিক কীভাবে শিকারের সময় সংগীত ব্যবহার করে সেই রহস্য এখনো উদ্ঘাটন করা যায়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh