পরীমণিকে ফাঁদে ফেলা কে এই অমি?

ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়িকা পরীমণিকে হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় গ্রেফতার গ্রেফতার ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ও তুহিন সিদ্দিকী অমির সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (১৫ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি শুনানি শেষে রিমান্ডের এ আদেশ দেন। মাদক মামলায় তাদের এ রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

এদিকে, পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলায় ঢাকার ক্লাবপাড়ার পরিচিত মুখ আবাসন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে তুহিন সিদ্দিকী অমির পরিচয়ও উঠে এসেছে। পুলিশ বলছে, এ ঘটনার নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেন অল্প সময়ে অঢেল বিত্তের মালিক হওয়া অমি। পরীমণির ঘটনা সামনে আসার পরপরই তিন নারীসহ অমির উত্তরার বাসায় গা-ঢাকা দেন নাসির। এ থেকে স্পষ্ট, অমির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

৮ জুন মধ্যরাতে কৌশলে পরীমণিকে আশুলিয়ার বেড়িবাঁধে ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যান অমি। অভিনেত্রীকে ফাঁদে ফেলতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এটা করেন তিনি। এরপর সেই রাতে পরীমণি ভয়ংকর নিপীড়নের শিকার হন। এ সময় অভিনেত্রীকে বাঁচাতে কোনো সহযোগিতা না করে উল্টো নিপীড়কদের সহায়ক হন তিনি। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পথ না পেয়ে চার দিন পর রবিবার অভিনেত্রী নিজেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি সবার সামনে আসে। এরপর নড়েচড়ে বসেন সংশ্নিষ্টরা।

এ ব্যাপারে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, অভিযুক্ত মূল দুই আসামিসহ পাঁচজনকে দ্রুত গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য এসেছে তাতে এটা স্পষ্ট, এ ঘটনার মূল হোতা অমি। সব অভিযুক্তকে আরও বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পরীমণি সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর তিন নারীকে নিয়ে অমির বাসায় পালান নাসির। মাদক রাখার অভিযোগে ওই তিন নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা রয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে জেনেছি।

কী ঘটেছিল সেই রাতে
ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা ও হুমকির অভিযোগে সাভার মডেল থানায় গতকাল অভিযোগ দায়ের করেছেন পরীমণি। মামলায় উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ, অমিসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। পরীমণি এজাহারে লিখেছেন, ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বনানীর বাসা থেকে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি, অমি, বনিসহ দুটি গাড়িযোগে উত্তরার উদ্দেশে রওনা হন। পথে অমি বলে, বেড়িবাঁধের ঢাকা বোট ক্লাবে তার দুই মিনিটের কাজ আছে। অমির কথামতো তারা ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে গাড়ি থামান। তবে বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে সিকিউরিটি গার্ডরা গেট খুলে দেয়।

পরীমণি বলেছেন, তখন অমি অনুরোধ করেন, সেখানকার পরিবেশ সুন্দর; চাইলে নামা যাবে। এরপর পরীমণি ও তার সঙ্গীরা ঢাকা বোট ক্লাবে ঢুকে টয়লেট ব্যবহার করেন। টয়লেট থেকে বের হওয়ার পরপরই নাসির উদ্দিন মাহমুদ তাদের ডেকে বারের ভেতরে বসার অনুরোধ করেন এবং কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে নাসির ও অমি তাদের মদপান করার জন্য জোর করেন। মদপান করতে না চাইলে ১ নম্বর আসামি জোর করে পরীমণির মুখের মধ্যে মদের বোতল ঢুকিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে পরীমণি সামনের দাঁত ও ঠোঁটে আঘাত পান। এ সময় নাসির তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করেন এবং ধর্ষণের চেষ্টা চালান।

একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস ও মদের বোতল ভাঙচুর করে অভিনেত্রীর গায়ে ছুড়ে মারা হয়। তখন কস্টিউম ডিজাইনার জিমি আসামিকে বাধা দিতে চাইলে তাকেও মারধর করা হয়। এ সময় ৯৯৯-এ কল করতে গেলে পরীমণির মোবাইল ফোনটি টান মেরে ফেলে দেওয়া হয়। অমিসহ অজ্ঞাতনামা চারজন এতে নাসিরকে সহায়তা করেন। পরীমণি তার সঙ্গীদের সহায়তায় ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পান। রাত ৩টার দিকে তিনি গাড়িযোগে প্রায় অচেতন অবস্থায় সঙ্গীদের সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে ফিরে আসেন। আসামিরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করছেন। এজাহারে পরীমণি আরও লিখেছেন, অমি পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে বনানীর বাসা থেকে ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যান।

কে এই নাসির
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নাসির উদ্দিন মাহমুদ ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্য। তিনি প্রায় চার দশক ধরে ডেভেলপার ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন। কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যানের পদেও আছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করেন। তার প্রতিষ্ঠান সরকারের গণপূর্ত অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ করে। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক সদস্য। তিনি ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে উত্তরা ক্লাবের সভাপতি এবং লায়ন ক্লাবের ঢাকা জোনের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া নাসির জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য। গত ডিসেম্বরে জাপার নবম কাউন্সিলে তিনি দলটির এই পদ পান।

অমির উত্থান
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্য একাধিক সূত্র জানায়, ক্লাবপাড়ায় অমিও একজন পরিচিত মুখ। তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন একসময় বিদেশে ছোটখাটো চাকরি করতেন। এরপর দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন। তবে সংসারে ভাগ্য ফিরে যখন ছেলে অমি আশকোনায় তাদের সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে নারী পাচার করেই প্রচুর অর্থ কামান তারা। বিত্তশালী ও তাদের বখে যাওয়া সন্তানদের বিপথে নিতে অমির জুড়ি নেই। ঢাকার উত্তরা ও আশকোনায় তাদের একাধিক বাড়ি ও প্লট রয়েছে। ওই এলাকায় এক নামে তাকে সবাই চেনেন। শত শত কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে ও প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন অমি। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সূত্র ধরে সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে অমির পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। অমিদের একাধিক আলিশান বাড়িতে রয়েছে সুইমিংপুলও। তাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। সেখানে অনেক সম্পদ গড়েছেন। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমও গড়েছেন অমি। দক্ষিণখানে একটি রিসোর্টের আড়ালে প্রায় প্রতিদিন মদ-জুয়ার আসর বসাতেন তিনি। ওই রিসোর্ট তার 'রঙশালা' নামে পরিচিত।

একাধিক সূত্র জানায়, নাসির ও অমির সিন্ডিকেট আগেও অনেক নারীর ওপর একই ধরনের নিপীড়ন চালিয়েছে। তবে নানা ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখা হয়। এবারও তাদের বিশ্বাস ছিল, পরীমণির ঘটনা তারা ধামাচাপা দিতে পারবেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনেত্রী এটা ফাঁস করবেন- এমনটা কল্পনায়ও ছিল না তাদের। প্রভাবশালী মহলকে ব্যবহার করে পরীমণির মুখ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করেও সফল হয়নি এই সিন্ডিকেট। এতেই দীর্ঘদিনের কুকর্ম সামনে এলো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //