অভিনয় করি দর্শকের জন্য: তমা মির্জা

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী তমা মির্জা। ক্যারিয়ারের অন্যতম সুসময় পার করছেন তিনি। গেল ঈদে মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফির ‘সুড়ঙ্গ’ তার ক্যারিয়ারে যুক্ত করেছে সাফল্যের আরও একটি পালক। ‘ময়না’ চরিত্রে তিনি দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটেছেন। এর আগে একই নির্মাতার ‘ফ্রাইডে’ ও ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেছিল অন্য এক তমা মির্জাকে। ব্যস্ত সময়ের মাঝেই তিনি অর্জন করেছেন স্নাতক ডিগ্রি। নিজের অর্জন ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তমার সঙ্গে দেশকাল পত্রিকার পক্ষ থেকে কথা বলেছেন মোহাম্মদ তারেক...

তমা মির্জা নামটি যেন ঢাকা পড়ে গেছে ‘ময়না’য়। জার্নিটা কেমন ছিল?‌
এমন একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজি হওয়াটাই চ্যালেঞ্জিং ছিল। এটি কোনো টিনএজারের কাহিনি নয়। চাইলেও আমি ন্যাকামি করে সংলাপ বলতে পারব না। ওভার এক্সপ্রেশনও সম্ভব নয়। নিশো ভাই (আফরান নিশো) একজন দক্ষ ও ভালোমানের অভিনেতা। তার অভিনয় সাবলীল ও বাস্তবধর্মী। তার সঙ্গে যদি আমি ওভার করে ফেলি, সেটি স্ক্রিনে খুব বাজে লাগবে। আমাকে ন্যাচারাল অভিনয় করতে হয়েছে। ব্যক্তি তমাকে সবাই চেনেন। আমি এই চরিত্রের মতো নই। আশপাশের যাদের সঙ্গে মিশি, তারাও এমন নয়। আশপাশেও এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তবে এই ময়নার মতো নারীকে আমরা জানি; কিন্তু কাছ থেকে দেখি খুব কম। তাই চরিত্রকে ভাবা একটু কঠিনই ছিল। ময়না যে কী চায়, তা বোঝা কঠিন। তার কথার চেয়ে যেন চোখমুখের অভিব্যক্তি বেশি থাকে- এটাই চেয়েছি। ময়নাকে সেভাবেই পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। টাকার প্রতি তার আলাদা মোহের বিষয়টি মুখে যতটা না সে বলে, চোখে তার থেকে বেশি প্রকাশ পায়। ময়নার চাহিদা খুব অল্প; কিন্তু সেই চাহিদা মেটানোর যে পথ সে বেছে নেয়, সেটা সঠিক নয়। দর্শকের মনে জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি অভিনয়শিল্পীদের জন্য এটি একটি রেফারেন্স চরিত্র হয়। সবার মনে যেন দাগ কাটে চরিত্রটি- এটাই ছিল আমার চেষ্টা।

এ ছবিতে তারকা অভিনেতা আফরান নিশোর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কেমন ছিল এ অভিজ্ঞতা?
এই সিনেমায় আমার চরিত্রটা একটু ট্রিকি। পরিচালক রাফীর সঙ্গে আমার আগে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। তিনি কাজের প্রতি খুবই হেল্পফুল। নিশো ভাইয়ের সঙ্গে এটা আমার প্রথম কাজ। তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন, নিশো ভাই আমার কাজটাকে আরও সহজ করে দিয়েছেন। অনেক বছর পর আমি এ রকম কষ্ট করে শুটিং করেছি। শুধু আমি না, পুরো টিম শুটিং করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। তার পরও শান্তির জায়গা একটাই যে, আমরা যতটুকু শুট করেছি, তাতে কোনো কম্প্রোমাইজ করিনি। যা-ই হোক না কেন, দিন শেষে কাজটা যে ভালো হচ্ছে- এটাই আমাদের পাওয়া।

‘সুড়ঙ্গ’ কি আপনার ক্যারিয়ারের সেরা ছবি?
দেখুন, অভিনয় করি দর্শকের জন্য। তারা যদি এটি বলে থাকেন, তা হলে তো আর কথা নেই। আমার কিন্তু ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘ফ্রাইডে’ও পছন্দের কাজ। তবে সুড়ঙ্গের ক্যানভাস অনেক বড়। এটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। কোটি কোটি দর্শক দেখছেন। ‘সুড়ঙ্গ’ আলাদা করে দর্শকের ভালোবাসা ও ভালোলাগার জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

ঈদে আপনার ছবির সঙ্গে আরও কয়েকটি ছবিও মুক্তি পেয়েছিল। সেগুলো নিয়ে অভিমত কী?
ঈদের ছবিগুলো দর্শক বেশ উপভোগ করছেন। এতেই বোঝা যায়, সিনেমার সুদিন ফিরছে। এবার ঈদের সিনেমার গান সুন্দর হয়েছে। অনেককেই বলতে শুনেছি, আগে সিনেমায় ভালো গান হতো, আমরা এখন কেন সে রকম গান পাই না। প্রিয়তমার ‘ঈশ্বর’ তো অসাধারণ। সুড়ঙ্গে ‘গা ছুঁয়ে বলো’ দারুণ হয়েছে। ‘প্রহেলিকা’, ‘ক্যাসিনো’, ‘লাল শাড়ি’ সিনেমায় সুন্দর সুন্দর গান শুনছেন শ্রোতারা। ঈদের সিনেমার সাফল্যের জন্য নির্মাতাদের পাশাপাশি প্রযোজকদেরও ধন্যবাদ দিতে চাই। সিনেমার ব্যবসা ভালো হলে চলচ্চিত্রের জন্যই মঙ্গল। যদি মনে করি, একটি সিনেমা ভালো যেতে হবে, তা হলে আমি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ভালো চাই না। চলচ্চিত্রের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে- এ রকম কথা আগে শুনতে পেতাম। এখন চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা বলে দিচ্ছেন, সিনেমায় কত লাভ হচ্ছে। কতটা খুশি হলে তারা এভাবে বলতে পারেন! 

‘সুড়ঙ্গ’ নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় কী বলবেন?
মুক্তির আগে থেকেই আলোচনায় ছিল সিনেমাটি। সুড়ঙ্গের দর্শক কথা কম বলে। তারা গঠনমূলক সমালোচনা করেন। সে জায়গা থেকে তারা যখন এসে কথা বলছেন, গল্পটা আলাদা। ময়না ভালো হলো না। তখন বুঝতে হবে, সিনেমাটি ভালো যাচ্ছে। তাদের মধ্যে চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। সব দর্শকের কাছেই ইতিবাচক কথা শুনেছি। এ-ও বলেছেন, আমাদের জুটিকে তারা একসঙ্গে দেখতে চান। সবাই পুরো টিমের প্রশংসা করছেন। প্রথম থেকেই বলছিলাম- এটি কারও একার সিনেমা নয়। টিমওয়ার্কের। দর্শক সাড়াই এটির প্রমাণ। দর্শককে না জানিয়ে অনেক হলে গিয়েছিলাম। চেয়েছি দর্শক মন খুলে হাসুক, গালি দিক, সিনেমাটি নিয়ে কথা বলুক। সিনেপ্লেক্সের দর্শক শিস বাজাচ্ছে, আইটেম গানের সঙ্গে নেচেছে। এমন চিত্র আগে কখনো দেখিনি। 

‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার পাইরেসি হয়েছে কলকাতায় মুক্তির পর। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মুক্তির প্রথম দুদিন কলকাতায় আমাদের সিনেমা ভালো বলে সবাই প্রশংসা করা শুরু করল আর ঠিক তার পর পরই সিনেমাটি পাইরেসি হয়ে গেল? জানেন তো পাইরেসি আমাদের দেশ থেকেই হয়েছে। দেশের বাইরে ‘সুড়ঙ্গ’ অনেক ভালো যাচ্ছে, সামনে আরও ভালো যেত আর সেটার পূর্বাভাস পেয়েই হয়তো এই পাইরেসি! যা-ই হোক, ভাইরা এবার একটু থামেন। আর দোয়া করেন যে কষ্ট আমাদের টিম পেল আর যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে, বাকি সিনেমাগুলোর যেন না হয়। পাইরেসি বন্ধ করা এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ আমাদের সিনেমা আমাদের সম্পদ, আমাদের গর্ব।

আপনি রায়হান রাফি পরিচালিত ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘ফ্রাইডে’, ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’য় অভিনয় করেছেন। তিনটি ফিকশনেই দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন? 
এক ধাঁচের গল্প দিয়ে দর্শককে আটকে রাখা চ্যালেঞ্জিং। দর্শক গল্প দেখতে চায়। এ ক্ষেত্রে পরিচালক অনেক সহযোগিতা করেছেন। কাজগুলো সফল করার জন্য চেষ্টার কমতি ছিল না। জীবনের অন্ধকার একটি অধ্যায়ের পর এভাবে যে ফিরে আসতে পারব ভাবিনি। সংশয়ে ছিলাম। দর্শক ব্যক্তি ও অভিনেত্রী তমাকে এক করে ফেলবে না তো? সে সংশয় দূর হয়েছে। আমি ইতিবাচক মতামত পাচ্ছি। প্রচার হওয়া কাজগুলোর জন্য সবাই শুভকামনা জানাচ্ছেন। অভিনয়ের জন্য দর্শকের প্রশংসা পেয়ে ভালো লাগছে। 

সম্প্রতি আপনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন আইন বিষয়ে। অভিনয়ের ব্যস্ততার মাঝে পড়ালেখা কীভাবে চালিয়ে গেলেন?
মা ও বাবার ইচ্ছাতেই আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছি। ২০১৮ সালে শুধু ‘প্রিয়তমার প্রিয়মুখ’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছিলাম। একেবারে যেন স্ক্রিন থেকে হারিয়ে না যাই সেজন্য করা। তার আগের বছর একটি ছবি করেছিলাম। তখনই লেখাপড়ায় মনোযোগ দিয়ে শেষ করি। আইনে পড়ার সুবিধা হচ্ছে- এখানে নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। যখন ইচ্ছা আবার শুরু করতে পারব। এখন আমি অভিনয়ে মনোযোগী, তাই ভবিষ্যতে আইন পেশা নিয়ে কতদূর কী করব এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। আমাকে বিশেষ করে সুবিধা দেওয়া হয়নি। অ্যাটেনডেন্সসহ আনুষঙ্গিক অনেক কিছুতে ভালো মার্কস থাকে। সেটাও আমি পাইনি। তবে আমি মনে করি স্টুডেন্ট লাইফে এটাই হওয়া উচিত। যা পেয়েছি তা আমাকে লেখাপড়া করে অর্জন করতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে- ল’ ডিপার্টমেন্টে পড়া অনেকটা কঠিন। প্রচুর লেখাপড়া এবং সময় দিতে হয়। বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগত। উত্তরা ও দিয়াবাড়ীর রাস্তায় জ্যাম লাগত। সকালের ক্লাস ধরতে গেলে আমাকে ভোরে রওনা দিতে হতো। আবার দেখা যেত সকালে ক্লাস, এর পর সন্ধ্যায় ক্লাস। পরদিন আবার শুটিং- এসব কিছু মিলিয়ে আমার অবস্থা হালুয়া টাইট হয়েছে। আইনে পড়তে গিয়ে ট্যাক্স বিষয়ে স্টাডি করতে গিয়ে আমার একটু বেশি কষ্ট হয়েছে। রাত নেই, দিন নেই আমি নোট সংগ্রহ করে পড়েছি। এতে আমার ব্যাচমেটদের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আমার শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার রেজাল্টে ফ্যামিলিও অনেক খুশি। কারণ অনেকে কাজ করতে গিয়ে লেখাপড়া শেষ করতে পারে না। তবে আমি ফাইনালি পেরেছি এবং এখন চেষ্টা করছি অভিনয়ে ফোকাস করতে।

নির্মাতা রায়হান রাফির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত জানাবেন বলেছিলেন... 
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ইন্টারভিউয়ে মজা করে কথাটি বলেছিলাম। প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এমন উত্তর দিয়েছি। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে জানানোর মতো কিছু নেই। ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে নিজের অভিনীত চরিত্র নিয়েই আলোচনায় থাকতে চাই। তবে ব্যক্তিগত জীবনে আমি যখন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাব, সেটা কাছের মানুষ ও দর্শকের জানার অধিকার আছে। শুধু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই আলোচনায় আসতে চাই।

-সাক্ষাৎকারটি দেশকাল পত্রিকার ১৯তম (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সংখ্যায় প্রকাশিত

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //