চমেক হাসপাতাল যেন কারাগার

কারাগারে কয়েদিদের নিয়ে যেমন বাণিজ্য চলে ঠিক তেমনি রোগীদের নিয়ে বাণিজ্য চলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আয়া, ওয়ার্ড বয়, নার্স, দারোয়ান, আনসার, লিফট চালক, ট্রলি ম্যানদের নজর শুধু রোগীর স্বজনদের টাকায়। টাকা দিলে রোগীর সাথে সাক্ষাৎ মেলে, না দিলে মেলে না। শুধু তাই নয়, টাকা ছাড়া ন্যূনতম সুবিধাও মেলে না এ হাসপাতালে। উপরন্তু কপালে জোটে দুর্ব্যবহার, গালাগাল ও অপমান।

অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করতে এসে টাকা ছাড়া ঢুকতে না দেয়ার প্রতিবাদ করায় হাসপাতালের দারোয়ান, আনসার ও ওয়ার্ড বয় মিলে তিন ভাইকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে। এরা হলেন চট্টগ্রাম মহানগরীর অক্সিজেন এলাকার মো. জাহেদ (৪৮), মো. আজাদ (৪৫) ও মনির হোসেন (৪২)। এর মধ্যে আহত আজাদকে চমেক হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী আজাদ জানান, বুধবার চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে তারা তিন ভাই তাদের অসুস্থ মাকে চমেক হাসপাতালের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে এনে ভর্তি করেন। আর রাত ৮টায় রাতের খাবার নিয়ে তারা ও তাদের এক ভাইয়ের স্ত্রী ওয়ার্ডে ঢুকতে চাইলে গেইটে থাকা আনসার টাকা ছাড়া তাদের ঢুকতে দেবে না বলে জানিয়ে দেন।

ওই সময় প্রতিবাদ করায় মেডিকেলের আরো কিছু কর্মচারী মিলে তাদের বেধড়ক মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। মেডিকেলের কর্মচারীরা এ সময় জাহেদ ও মনিরকে মেডিকেলের পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। পুুলিশ তাদের আটকে রাখে। পরে স্বজনরা গিয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে উৎকোচের বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন।

উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, নিয়ম না মানার কারণে হাসপাতালের কর্মচারীরা জাহেদ ও মনিরকে পুলিশ হেফাজতে দেয়। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এদিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও স্বজনরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালের প্রতি ইঞ্চি পেরোতে টাকা দিতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আনসারকে, লিফট ব্যবহারে, ওয়ার্ডে ঢুকতে, ট্রলিতে বা হুইল চেয়ারে করে রোগী আনা নেওয়া করতে, আয়াদের সাহায্য নিলে, রোগী কেমন আছেন একটু দেখার অনুরোধ করলে দারোয়ান ও নার্সকে টাকা দিতে হয়। বকশিস দিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের খুশি করতে পারলে সেবা পাওয়া যায়। নয়তো ঝাড়ি খেতে হয়। এছাড়া রোগীর জন্য ওষুধ বা ইনজেকশন কিনতে বাইরে যাওয়ার পর ওই ওষুধ বা ইনজেকশন নিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকতে গেটে বাধা দেয় আনসার বা দারোয়ান। টাকা দিলে প্রবেশ, নয়তো প্রবেশ নিষিদ্ধ।

মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগীর স্বজন আনিসুর রহমান বলেন, আমার চাচা একজন প্যারালাইজড রোগী। তাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে হুইল চেয়ারের জন্য আয়াকে ১০০ টাকা দিতে হয়। লিফটম্যানকেও দিতে হল ৫০ টাকা। বুঝতে পারছি না এটা কি সরকারি হাসপাতাল?

গাইনি বিভাগের বাইরে অবস্থানরত অলিউল্লাহ বলেন, আমার স্ত্রী সিজারে এক সন্তান প্রসব করে ৫ দিন হলো। রাতের দিকে স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে আমি নার্সদের ডাকতে যাই। তখন তারা আমাকে বলে, আপনি যান সময় হলে আসবো। সারাক্ষণ আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বসে থাকার সময় নেই। এদের ব্যবহারে মনে হয়, এরা জেলখানার পুলিশ, রোগী ও রোগীর স্বজনরা কয়েদি।  

শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যায় স্বজনদের ভিড়। তাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালের স্টাফগুলোর মধ্যে কোনো দয়ামায়া নেই। তারা তাদের ব্যবসা নিয়ে আছে। বাচ্চার জন্য ওষুধ, ফলমূল নিয়ে আসছি কিন্তু টাকা ছাড়া ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেক সময় ভিজিটিং আওয়ারে রোগীর অনেক স্বজনরা আসেন, তখনও তাদের টাকা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আগেও এমন অবস্থা ছিল। যখন অবৈতনিক কর্মচারীরা কাজ করতো। তাদের বেতন চলতো রোগীর স্বজনদের পকেট থেকে। নানা অভিযোগের পর তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে জনবল নিয়োগ দিলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের নিয়মেই চলছে টাকা আদায়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে বর্তমানে ১০০জন আনসার কর্মরত আছেন। তাদের মাসিক বেতন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি মাসে রেশন সুবিধা পায়। তাদের বসবাসের জন্য আছে সরকারি কোয়ার্টার।

এ বিষয়ে আনসার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেন বলেন, এরকম অভিযোগ আগে ছিল। এখন তেমন নেই। তারপরেও যদি এমন হয়ে থাকে এবং উপযুক্ত প্রমাণ থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম বলেন, রোগীর স্বজনরাই টাকা দিয়ে হাসপাতালের স্টাফদের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। কে কোথায় টাকা নিচ্ছে সে বিষয়ে তো আমরা অবগত নই। রোগীপক্ষ অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //