ব্রীধান-৫১ বীজে ভেজাল: ঝিনাইদহের কৃষকদের মাথায় হাত

ঝিনাইদহের কৃষকদের মাথায় হাত। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ধান বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন তারা। ক্ষেতে লাগানো ধান গাছ কোনটি ছোট, কোনটি লম্বা আকার ধারণ করেছে। ওইসব গাছ থেকে আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ছড়া বের হওয়া শুরু হবে। 

এদিকে বীজ সিন্ডিকেট সদস্যরা ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ কৃষক লীগ ঝিনাইদহ জেলা শাখার পক্ষ থেকে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে, কৃষিমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ঝিনাইদহের উপ-পরিচালকের দফতর সুত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমে জেলায় ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক লাখ চারহাজার ২৫ হেক্টর। এক লাখ চার হাজার ১২৮ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এ থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৫২ হাজার ৫১৫ মেট্রিকটন ধান। কিন্তু কৃষকরা বীজ কিনে প্রতারিত হওয়ার কারণে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। 

প্রাপ্ত তথ্য মতে বিএডিসি কতৃক সরবরাহ করা ব্রীধান-৫১ বীজে ভেজাল ধরা পড়েছে। ধানের মাঠ পরিদর্শনকালে সদর উপজেলার ছোট কামার কুন্ডু গ্রামের কৃষক মিন্টু বিশ্বাস জানান, বিএডিসির সরবারহ করা ব্রীধান-৫১ বীজ থেকে চারা করে ক্ষেতে লাগানোর কিছুদিন পরেই মিশ্রণ দেখতে পান। এখন ধান গাছ গুলো থেকে ছড়া বের হওয়ার সময়। কিন্তু জমিতে ছোটবড় নানা জাতের ধান গাছ দেখা যাচ্ছে। 

একই গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা বলেন, ফলন বেশি হওয়ার আশায় মাঠের পর মাঠ ব্রীধান-৫১ চাষ করেছেন তারা। অথচ জমিতে ভেজাল ধানের গাছ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ঘটনায় তাদের সকলের মাঝে উৎপাদন কম হওয়ার আতংক বিরাজ করছে।

ডেফলবাড়ি গ্রামের শরিফ হোসেন, কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের উসমান, বেড়াশোলার তুহিন মিয়া, কোটচাদপুরের দয়ারামপুর গ্রামের রেজাউলসহ শত শত কৃষক একই অভিযোগ করেছেন। 

বিএডিসি বীজ ডিলার সদর উপজেলার হাটগোপালপুরের মিন্টু দত্ত বলেন, বিএডিসি থেকে সংগ্রহ করা ব্রীধান-৫১ বীজের প্যাকেট খুলে কৃষকরা রত্না ধানের মিশ্রণ পেয়েছেন। 

তিনি অভিযোগ করেন, বাজার থেকে সাধারণ ধান কিনে বিএডিসি বীজ হিসেবে প্যাকেট করে বিক্রি করা হয়েছে। 

এ ঘটনার পিছনের রহস্য কি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুজতে বেরিয়ে আসে বিএডিসির দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের খবর। প্রাপ্ত তথ্য মতে ঘটনাটি প্রথম ধরা পড়ে কালীগঞ্জ উপজেলা ও সদর উপজেলার হলিধানী এলাকায়। 

সদর উপজেলার বর্তমান কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, বিষয়টি প্রথমে নজরে আসেন তার ও তিনি কালীগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত থাকাকালীন ব্রীধান-৫১ বীজ থেকে অন্য জাতের ধান গাছ গজিয়ে উঠেছে মর্মে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ বিএডিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আবহিত করেন।  

প্রাপ্ত তথ্য মতে, পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গাতে বিএডিসির বীজ প্রসেস কেন্দ্র রয়েছে। ওই কেন্দ্র থেকে পাঠানো বীজে সবচেয়ে বেশি ভেজাল ধরা পড়েছে। আমন মৌসুমের শুরুতে বীজগুলো সরাসরি কৃষক ও ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। আমফানের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিএডিসি বীজ বিপণন কেন্দ্র যশোর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা থেকে কৃষকরা এ ধান বীজ সংগ্রহ করেছে। 

কৃষি বিভাগ বলেছে, ২০১০ সালে ধানটি কৃষক পর্যায়ে দেয়া শুরু হয়। এ ধানের বৈশিষ্ট হলো গাছগুলো মোটা বেটে গাঢ় সবুজ ও বালায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকায় কৃষকদের কাছে অল্প দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। হেক্টর প্রতি ফলনও ভাল হয়। এক হেক্টর জমিতে ৩০-৩৫ কেজি বীজের দরকার পড়ে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যশোর বীজ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র থেকে গত ১৩ মে ৫১১৯০ নং চালানে আট টন, ৭ জুন ২৪৮১১ নং চালানে আট টন ও ১৪ জুন ২৪৮২৪ নং চালানে আট টনসহ মোট ২৪ টন ও চুয়াডাঙ্গা অধিক বীজ উৎপাদন কেন্দ্র (বীজ প্রসেস কেন্দ্র বীউ) থেকে ৭৮৯  নাম্বার চালানে ১০ টন প্রত্যায়িত ধান বীজ ঝিনাইদহের বিক্রয় কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। 

এছাড়াও মাগুরা বিক্রয় কেন্দ্র থেকে প্রত্যায়িত দুইটন ও চলতি বছরের ১২ জুন যশোর গুদাম (বীজ প্রসেস কেন্দ্র) থেকে আরো পাঁচটন ভিত্তি ব্রীধান-৫১ বীজ একই বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। অর্থাৎ প্রত্যায়িত ৩৬ টন ও ভিত্তি বীজ চারটন বিএডিসি স্থানীয় বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা শৈলকুপা ও হরিণাকুন্ডুর সরাসরি কৃষক ও ডিলারদের  মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। 

এছাড়াও যশোর বীজ বিপণন কেন্দ্র (বিবি) থেকেও কালীগঞ্জ, কোটচাদপুর, মহেশপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় একই ধান বীজ বিক্রি করা হয়েছে। প্রতি কেজি বীজের ডিলার মুল্য ২৫ টাকা ৫০ পয়সা ও কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে হবে ৩০ টাকা প্রতি কেজি। কিন্তু কৃষকরা জানান, তারা প্রতি ১০ কেজির বস্তা কিনেছেন ৩৫০ টাকায়। 

অনুসন্ধান কালে জানা যায়, খাতা কলমে ঝিনাইদহ জেলায় বিএডিসির সর্বমোট ৮২ জন ডিলার রয়েছেন। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১৬, শৈলকুপায় ২০, হরিণাকুন্ডুতে ৫ ,মহেশপুরে ১৭, কোটচাঁদপুরে ৭ ও কালীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ১৭ জন। এসব ডিলারের মধ্যে বড় একটি অংশ ভুয়া। যাদের কোন দোকান, গুদাম নেই। ভুয়া ডিলারদের নামেও বিএডিসি বীজ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তবে ওই বীজ বেশি মুল্যে বিক্রি করা হয় কৃষকদের কাছে। এখাত থেকে প্রতি মৌসুমে সংশ্লিষ্টদের পকেটে আসে হাজার হাজার টাকা। 

বিএডিসি ঝিনাইদহের উপ-সহকারি পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সহকারী পরিচালক) মো. শফিউদ্দিন সবুজ এধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তার ভাষায় ভুয়া ডিলারদের নামে বরাদ্দের বীজ বিক্রি করে বাড়তি কিছু অর্থ পকেটে আসে। বিনিময়ে ওই ডিলারদের প্রতিবছরের লাইসেন্স নবায়ন করে দেয়া হয়। ব্রীধান-৫১ বীজে ভেজাল ধরা পড়েছে মর্মে সরাসরি স্বীকার করেন বিএডিসির এ কর্মকর্তা। বর্তমানে ডিলার ও কৃষকদের চাপের মুখে রয়েছেন বলেও স্বীকার করেন তিনি। তবে কি কারণে বীজে ভেজালের ঘটনাটি ঘটেছে তা জানাতে অস্বীকার করেন তিনি। 

এদিকে জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম বলেন, গোটা জেলায় ব্রীধান-৫১ জাতে ভেজাল ধরা পড়েছে। অনেক কৃষক বীজতলায় চারার মিশ্রণ দেখতে পেয়ে সে চারা রোপণ করেননি। কিন্তু যারা রোপন করেছেন তারা এখন ফলন না হওয়ার আশংকায় ভুগছেন। এব্যাপারে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রী বরাবর সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে একটি স্মারক লিপি দেয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিএডিসি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বড় ধরনের একটি প্রতারক সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে বীজের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। বীজ মিশ্রণসহ এ ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ জানান, ব্রীধান-৫১ বীজে মিশ্রণ ধরা পড়েছে মর্মে খবর সত্য। বিষয়টি নিয়ে জেলা সার বীজ মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সভায় ভেজাল বীজ বিক্রির সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারিদের বেতন থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাসহ শাস্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //