এস. কে সাহেদ
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৪:৫৪ পিএম
‘যুদ্ধের আগোত স্বামী-সন্তান ধরি মোর সুখ আছিল। যুদ্ধের সময় ওই শয়তানগুলা মোর কপালোত দুঃখ লেখি দিছে, সেই দুঃখ মোর এ্যালাং আছে। চোখ দুখ্যান বন্ধ করলে ওইল্যাং ভাসি উঠে। এইল্যা কথা আগোত কাকো কং নাই। মোর মরণের সময় হইছে, এ্যালা আর শরম করি কি হইবে।’ যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া স্মৃতি মনে করে এভাবেই অনুভূতি জানান তিস্তা পাড়ের জহিরন বেওয়া (৭৪)। বেঁচে থাকতে তিনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চান।
বীরাঙ্গনা জহিরন বেওয়ার জীবনে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও পৈশাচিক ঘটনা কেউ জানতে চাইলে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকাতেন। জীবনের শেষ সময় এসে তিনি এসব ঘটনা বলতে আর মুখ লুকাচ্ছেন না। বেশ আগ্রহ নিয়েই প্রকাশ করছেন সেসময় তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ ঘটনা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষা গ্রামের তিস্তা পাঙ্গাটারী। গ্রামটি তিস্তা রেল সেতু থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রেল সেতুর পাশে গড়েছিল ক্যাম্প। এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে হামলা পরিচালনা করেছিল। নারীদের ধরে নিয়ে এসে এই ক্যাম্পে আটকে রেখে তারা চালাত অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন। তাদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকারদের মধ্যে একজন জহিরন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৫বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী ছিলেন জহিরন বেওয়া। বড় মেয়ে আছিয়া বেগমের বয়স ছিলো দশ বছর আর ছেলে নানকু মিয়ার বয়স ছিলো দেড় বছর। তারিখ ও মাসের নাম মনে না থাকলেও সেদিন যে শনিবার; দুপুর ছিলো তা মনে আছে জহিরনের। তার স্বামী কাজীম উল্ল্যাহ পাট কেনা-বেচার কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন। মেয়ে আছিয়া বেগম ছিলো নানার বাড়িতে। জহিরন ঘরে বসে তার দেড় বছরের শিশু নানকুকে খাওয়াচ্ছিলেন। গ্রামে হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেছে বলে মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন। ঘরে স্বামী নেই, মেয়েও নেই, তাই জহিরন দুধের শিশুকে নিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। ফলে জহিরন ধরা পড়ে যায়। দুধের শিশুটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে শিশুর সামনেই পাকিস্তানি বাহিনীর তিন সদস্য মিলে জহিরনের সঙ্গে অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতন করে। তবে এখানেই শেষ নয়। কান্নারত শিশু ও জহিরনকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। তিস্তা রেল সেতুর পাশে পাকিস্তানি ক্যাম্পে জহিরনকে তিন দিন আটকে রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।
পরবর্তীতে জীবন নিয়ে জহিরন বাড়িতে ফিরে আসলেও হারিয়ে যায় তার মুখের হাসি, মলিন হয়ে যায় তার মুখশ্রী। কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলেন না। একাকী থাকেন আর নীরবে কাঁদেন।
জহিরন বেওয়া জানান, তার স্বামী প্রথমে তাকে মেনে নিতে না চাইলেও কয়েকদিন পর মেনে নেন। কিন্তু স্বামীর সংসারে মন বসাতে পারছিলেন না তিনি। এ ঘটনার পর থেকে কোনদিনই স্বামীর সামনে মাথা উঁচু করে থাকতে পারেননি। স্বামীর সকল অন্যায়-অত্যাচার মেনে নিতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর আরো দুই সন্তানের জন্ম দেন জহিরন। স্বামী কাজীম উল্ল্যাহ ২০ বছর আগে মারা গেছেন। সন্তানরা সবাই আলাদা সংসার করছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর জহিরনের জীবন চলছে সরকারি বয়স্ক ভাতা আর অন্যের বাড়িতে কাজের মজুরী দিয়ে। বেঁচে থাকতেই জহিরন বেওয়া, সরকারের কাছে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির দাবি জানান।
ABOUT CONTACT ARCHIVE TERMS POLICY ADVERTISEMENT
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ | প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ
প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী | ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
© 2021 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh