নিজের উদ্ভাবিত ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর নিধন করেন আবুল

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের জামাল ইউনিয়নের উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন জোয়ার্দার। বয়স ৮২। পেশায় পল্লী পশু চিকিৎসক। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রায় ২ লাখ ইঁদুর নিধন করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেছেন নিজের উদ্ভাবিত বাঁশকল (ফাঁদ)। মৃত ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে সরকারি ইঁদুর নিধন দিবসে উপজেলা থেকে কয়েকবার সম্মাননাও পেয়েছেন।

আবুল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ দিয়ে তৈরি করা রয়েছে প্রায় শতাধিক বাঁশকল বা ফাঁদ। বাড়ির অন্যপাশে তৈরি করা হচ্ছে আরো অনেকগুলো ফাঁদ। বসতবাড়ি ও ফসলী ক্ষেতে ইঁদুরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার কৃষকেরা তার বাড়িতে এসে বিনামূল্যে বাঁশকল নিয়ে যাচ্ছেন। টিনের তৈরি একটি চালা ঘরে বেশ কিছু টিনের কৌটার মধ্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে মরা ইদুরের অসংখ্য শুকনো লেজ, যা তিনি উপজেলাতে জমা দেয়ার অপেক্ষায় আছেন।  

আবুল হোসেন জোয়ার্দার জানান, ১৯৬৯ সালে চট্রগ্রামের বাবুনগর মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে তিনি পল্লী পশু চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ কোর্স শেষ করেন। এরপর বিস্তর এলাকায় শুরু করেন পশু চিকিৎসেবা। এ কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে শুরু করেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল বিনষ্টকারী ইঁদুর নিধন।

তিনি বলেন, কৃষকেরা অনেক কষ্ট করে পয়সা ব্যয় করে ফসল উৎপাদন করেন। সেই ফসল ইঁদুর বিনষ্ট করে। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। তাই কৃষকদের উপকারে তিনি শুরু করেন ইঁদুর নিধন, যা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রথমে বাজারের কেনা কল বা ফাঁদ ব্যবহার করতেন। এ ফাঁদে তেমন একটা কাজ করে না। তাছাড়াও ব্যয়বহুল হওয়ায় পরে মাথা খাটিয়ে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ফাঁদ বাঁশকল। তার এ চেষ্টা আজ সফল হয়েছে। এলাকায় এটা আবুলের বাঁশকল হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষের সময় এ ফাঁদগুলো নিজের উদ্যোগে মাঠের বিভিন্ন ক্ষেতে পেতে রাখেন। কয়েক দিন পরে দেখেন অনেক ইদুর ফাঁদে আটকা পড়েছে। অনেকগুলো মারাও গেছে।

আবুল হোসেন আরো জানান, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামের মাঠে তার কয়েক হাজার বাঁশকল পাতা আছে। এখন আমন ধানের মৌসুম চলছে। ইতোমধ্যে প্রত্যেক মাঠ থেকে বাঁশকলগুলো বাড়িতে আনা শুরু করেছেন। আবার রবি শস্য পাকলে দেয়া হবে। এ মৌসুম শেষ হতে না হতেই আবার বোরো মৌসুমের ধান পাকা শুরু হবে। তখন আবার সেখানে ফাঁদগুলো পাতা হবে।

তিনি বলেন, শুধু পেতে আসলেই হয় না। মাঝে মধ্যে আবার মাঠের ফাঁদগুলো দেখে আসতে হয়। বাঁশকলের মধ্যে খাবার ফুরিয়ে গেলে আবার খাবার দেয়া লাগে। আর আটকে পড়া ইঁদুরগুলো বের করে নিয়ে লেজ কেটে নিয়ে আসেন। আর পরিবেশ সুরক্ষায় মাটি খানিকটা গর্ত করে মরা ইঁদুরের দেহাবশেষ পুতে রাখেন। লেজগুলো বাড়িতে এনে প্রথমে রোদে শুকান। পরে এগুলোকে জ্বলন্ত আগুনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেঁকে জীবাণুমুক্ত করে শুকিয়ে বিশেষ কৌটায় ভরে রাখেন। বছরের ইঁদুর নিধন সপ্তাহে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে কৃষি অফিসে জমা দেন। লেজ জমা দিয়ে এ পর্যন্ত তিনিই প্রতিবছর সেরা হন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে এসে ফাঁদ নিয়ে যান। এটা তিনি কৃষকসেবা হিসেবে মনে করেন।

তার দাবি, প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২ লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। আগে লেজসহ মরা ইঁদুর মাটিতে পুতে রাখতেন। কিন্ত সরকারিভাবে যেদিন থেকে ইঁদুর নিধনের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেদিন থেকেই আরো বেশি উৎসাহিত হয়েছেন। 

উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোমিন জানান, আমি ছোটবেলা থেকে গ্রামের আবুল হোসেনকে দেখছি পশু-পাখির চিকিৎসাসহ কৃষকের ফসলীক্ষেত, বসতবাড়ির ইঁদুর মেরে সেবা দিচ্ছেন। তার তৈরি ইঁদুর মারার বাঁশকল বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ বিনামূল্যে নিয়ে যান।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হুমায়ন কবির জানান, কৃষকদের ফসলী ক্ষেতের জন্য ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া কমপক্ষে ৬০ রোগের জীবাণু বহন করে। এই ইঁদুর নিধনে আবুল হোসেন নিজের তৈরি বাঁশকল দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর তিনি প্রচুর পরিমাণে ইঁদুরের লেজ জমা দেন। ইঁদুর খুব দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটায়। ইঁদুরের গর্ভধারণকাল ১৮ থেকে ২২ দিন পর্যন্ত হয়। বাচ্চা প্রসবের পরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। ফলে বোঝায় যাচ্ছে নিধন করা কতটা জরুরি। যে কাজটি আবুল হোসেন বিনা পারিশ্রমিকে করে থাকেন। 

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মুহাম্মদ মোহায়মেন আক্তার জানান, ইঁদুর পাকা ধান, গম, রবিশস্য, সবজি, বাসাবাড়ির কাগজপত্র, কাপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে। কৃষি জরিপে দেখা গেছে, ইঁদুর বেশিরভাগ সেচনালায় গর্ত করে পানির অপচয় ঘটায়। ফসল কাটার পূর্বে ধানক্ষেত ৫ থেকে ১৭ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট করে। ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টন খাদ্য খেয়ে ফেলতে পারে। এ ইঁদুর নিধনের জন্য উপকারী প্রাণী প্যাঁচা, শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সাপ, গুই সাপ, বিড়াল জাতীয় প্রাণী কমে যাওয়ায় মাঠে ও বাসা বাড়িতে ইঁদুর বেড়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। কিন্ত স্বেচ্ছায় আবুল হোসেন তার উদ্ভাবিত বাঁশকল কৃষকদের সেবা প্রদান করছেন। 

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সূবর্ণা রানী সাহা জানান, ফসলী ক্ষেতের জন্য ইঁদুর একটি ভয়ানক শত্রু। প্রতিবছর সরকারিভাবে ইঁদুর নিধন সপ্তাহ দিয়ে ইঁদুর নিধনে কাজ করা হয়। কৃষকদের ইঁদুর নিধনে উৎসাহিত করতে মরা ইঁদুরের লেজ জমা নিয়ে জমাদানকারীকে সন্মাননা প্রদান করা হয়। এ উপজেলায় আবুল হোসেন জোয়ার্দার প্রতিবছরই সকলের চেয়ে বেশি জমা দিয়ে আসছেন। তার নিজের প্রযুক্তিতে তৈরি বাঁশকল এলাকার সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বিনা পারিশ্রমিকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে সেবাটা দিচ্ছেন, বলা যায় আবুল হোসেনই কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু। তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //