মেঘনার চরে ২০০ কোটি টাকার সয়াবিনের আবাদ

মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা বিশাল চরে হাজার একর জমিতে চাষ হয়েছে বীজ সয়াবিন। লক্ষ্মীপুরে অসময়ে উৎপাদিত এ কাঁচা সয়াবিনের পুরোটাই বীজ সয়াবিন হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের নিকট বিক্রি হচ্ছে। 

পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে এ বীজ সয়াবিন সংগ্রহ, মাড়াইসহ ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েক হাজার সয়াবিন চাষী। এ অঞ্চলের কয়েকটি চর থেকে অসময়ে উৎপাদিত এ সয়াবিনের পরিমাণ ১০ হাজার টনেরও বেশি। যার বাজার মূল্য প্রায় ২শ কোটি টাকা। আর এ বীজ সয়াবিন উৎপাদনে জড়িয়ে আছে চরের ভূমিহীন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। কাচাঁ সয়াবিন দ্বিগুণ দামে বিক্রি হওয়ায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। 

ফলে নদীর বুকে জেগে উঠা বিশাল চরাঞ্চলগুলোতে সয়াবিন বীজ উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আগাম এ বীজ সয়াবিন আবাদ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন এ অঞ্চলের সয়াবিন চাষীরা।

এ অঞ্চলের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে শুকনো ও বিএডিসি থেকে সয়াবিনের বীজ সংগ্রহ করেন। বছর দুয়েক ধরে জেলার চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুরচর, খাসিয়ার চর ও চরইন্দুরিয়ার বিশাল চরাঞ্চলের কৃষকরা আশ্বিন মাসের মাঝামাঝিতে বীজ সয়াবিন রোপন করেন। পৌষ মাসের শুরুতেই ওই বীজ বিক্রির উপযোগী হয়। কৃষক উৎপাদিত বীজ দিয়েই আবার নতুন করে সয়াবিন আবাদ শুরু করে। এদিকে প্রতি দেড় শতক জমিতে বীজ সয়াবিন আবাদ হয় ২০ কেজি আর মৌসুমে ১ একর (১৬০ শতক) জমিতে সয়াবিন উৎপাদন হয় ৪০ মণ। কাঁচা বীজ সয়াবিন প্রতি মণ বিক্রি হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আর মৌসুমে সয়াবিন বিক্রি হয় প্রতি মণ ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়।

 

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, রায়পুর উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের মেঘনার নদীর চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়া ও সদর উপজেলার মেঘার চরে গত ৩/৪ বছর যাবত অসময়ে (বর্ষাকালে) সয়াবিন চাষ করছে চরের কৃষকরা। এসব চরে অসময়ে প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। এ সয়াবিন সাধারণত বীজ সয়াবিন হিসেবে তারা বিক্রি করছে। প্রচলিত সয়াবিনের তুলনায় দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদিত এ সয়াবিনের বাজার মূল্য প্রায় দুইশত কোটি টাকা। 

রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের চরকাচিয়া পানির ঘাট এলাকার সয়াবিন বীজ ব্যবসায়ী স্বপন গাইন জানান, ওই ইউনিয়নের চরকাচিয়া পানির ঘাট ও মোল্লারহাটে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বীজ সয়াবিনের হাট বসে। চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুরচর, খাসিয়ার চর ও চরইন্দুরিয়ায় উৎপাদিত সয়াবিন এসকল বাজারে আসে। প্রতি হাটে গড়ে প্রায় ৫’শত থেকে ১ হাজার টন সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে হায়দারগঞ্জ, হাজীমারাসহ উপজেলার আরো পাঁচটি বাজারে সয়াবিন বীজের এ হাট বসে। লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন চাষী ও ব্যবসায়ীরা ছাড়াও নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বীজ ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সয়াবিন বীজ কিনে নেন। 

রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের পানির ঘাট হয়ে চরকাচিয়া ও টুনুর চরে গিয়ে দেখা গেছে, চরাঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে বীজ সয়াবিনের আবাদ করা হয়েছে। কৃষকরা গাছ থেকে পাকা সয়াবিন মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। মাড়াই করা এসব সয়াবিন ওই জমিতে সয়াবিন আবাদের  জন্য চাহিদা অনুসারে বীজ রেখে বাকি বীজ নৌকায় করে ঘাটে নিয়ে যাচ্ছে কৃষক। ঘাটে আড়তদার ও পাইকারী বীজ বিক্রেতারা তা সংগ্রহ করে বীজ সয়াবিনের প্যাকেট করে এগুলো বিক্রি করছেন অন্যত্র।

স্থানীয় চরবংশী ইউনিয়নের মোল্লারহাট বাজার ও পানিরঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন শুকনো বীজ যেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে একশ টাকা সেখানে কাঁচা নতুন বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২১০ টাকায়। গত প্রায় ১ মাস ধরে এ বীজ ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত সয়াবিন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। 

কানিবগার চরের সয়াবিন চাষী ইসমাঈল ব্যাপারী জানান, আগের বছরের শুকনো বীজের তুলনায় নতুন কাঁচা উৎপাদিত বীজ শতভাগ গজায়। সে কারণে দ্বিগুণ বেশি দামেও কৃষক কাঁচা সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করে।  


চরকাচিয়ায় ২০ একর জমিতে সয়াবিন আবাদ করেন শাহজাহান মোল্লা। তিনি জানালেন, গত দুই বছর আগেও তিনি স্থানীয় কৃষক ও বিএডিসি থেকে সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করতেন। গত বছর তিনি স্থানীয় এক কৃষকরে পরামর্শে কাঁচা বীজ সয়াবিন চাষ শুরু করেন। ফলনও হয় ভালো। এ মৌসুমে ২০ একর জমিতে আগাম বীজ সয়াবিন আবাদ করে প্রতি একরে তিনি ১২ মণ করে বীজ সয়াবিন পেয়েছেন। আগাম এ বীজ সয়াবিন আবাদ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন তিনি। এবছরও নিজের উৎপাদিত বীজ দিয়েই ওই ২০ একর জমিতেই সয়াবিন আবাদ করবেন তিনি। 

একই এলাকার সয়াবিন চাষী নুর নবী হাওলাদার জানান, দুই একর জমিতে তিনি আগাম সয়াবিন আবাদ করেছেন। এ কাঁচা সয়াবিনের কেজি দুইশত টাকা দরে ৪’শ কেজি সয়াবিন বিক্রি করেছেন তিনি। এবছর চরে কয়েক দফা জলোচ্ছাসের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তবুও ২ একর জমিতে তিনি ২৫ মণ সয়াবিন পেয়েছেন। দাম ভালো পাওয়ায় বেশ লাভবান হচ্ছেন তিনি। নিজেদের উৎপাদিত বীজ দিয়েই নতুন করে সয়াবিন আবাদ শুরু করবেন বলে জানালেন তিনি।

রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারে কথা হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার বীজ ব্যবসায়ী মহিন হোসেনের সাথে। তিনি জানান, প্রতি টন বীজ সয়াবিন ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দরে ৪ টন সয়াবিন ক্রয় করছেন। খুচরা বিক্রেতাদের নিকট তিনি কেজিতে ৫ টাকা লাভে বিক্রয় করছেন।

রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল এলাকার মনসুর হাওলাদার, হাশেম খাঁসহ কয়েকজন সয়াবিন চাষী জানায়, ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস হচ্ছে সয়াবিন চাষের প্রধান মৌসুম। কিন্ত এ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই চর থেকে বীজ সয়াবিন ঘরে তোলেন কৃষক। 

বাজারে চরের কাঁচা সয়াবিন বীজের প্রভাব সর্ম্পকে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসির) লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র পরিচালক শরীফ উল্লাহ জানান, বিগত বছরে সয়াবিন চাষীদের মাঝে প্রায় ৩শ থেকে ৫শ টন বীজ বিক্রয় করেছিল বিএডিসি। কিন্ত এবার মাত্র ৫ টন চাহিদা পাওয়ার কথা জানালেন তিনি। বিএডিসির বীজ একশ টাকার নিচে বিক্রয় হলেও কৃষক তা কিনছে না বলেও জানান এ কর্মকর্তা। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশের অন্তত ৩৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় ৩-৪ লাখ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। যেখান থেকে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। যার শতকরা ৬০ ভাগ সয়াবিন উৎপাদিত হয় লক্ষ্মীপুরে। কিন্ত সয়াবিন উৎপাদনের প্রধান সমস্যা ছিল বীজ। 

তিনি জানান, এবার চরে উৎপাদিত সয়াবিন বীজ সমস্যা সমাধানে দেশকে একধাপ এগিয়ে নেবে। 

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বেলাল হোসেন খাঁন জানান, এবছর লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হবে। সেখানে ২ হাজার ৭৩০ টন বীজ লাগবে। কিন্ত চরে উৎপাদিত বীজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায়ও বিক্রি হচ্ছে। 

বাংলাদেশ সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম দেশ। বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রধান জেলা লক্ষ্মীপুর। সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকার কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের ব্র্যান্ডিং নাম রাখেন সয়াল্যান্ড। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //