শেরপুরে কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে ‘বেবি কর্ন’

শেরপুরের চরাঞ্চলের কৃষকদের আশার আলো জাগাচ্ছে ‘বেবি কর্ন’।  শুধু সবজিই নয়, এর সবুজ গাছ গরুর জন্য উন্নত পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চরাঞ্চলের পরিত্যাক্ত বেলে মাটি এ ফসলের জন্য উপযোগী।

শেরপুরের চরাঞ্চলে বেবি কর্ন ফসলের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষনাকারী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী শেরপুরের জমশেদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পার্থ সারথী কর জানায়, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ০.৭২ মিলিয়ন হেক্টর জমি চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের বেশিরভাগ মাটিই বেলে এবং মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা খুবিই কম। জমিতে জৈব পদার্থের পরিমান খুবই কম এবং উর্বরতাও কম। ফলে চরাঞ্চলের ফলন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় খুব কম। রাসায়নিক সার সংযোজনের মাধ্যমে শস্যের উৎপাদনশীলতা উন্নত করা যায়। তবে রাসায়নিক সার ব্যয়বহুল এবং সাধারণত অনেক দরিদ্র কৃষকের নাগালের বাইরে। অন্যদিকে, এটি মোটেই লাভজনক নয়। চরাঞ্চলের প্রধান ক্রপিং প্যাটার্ন (ফসল বিন্যাস) হলো বারো ধান ও পতিত আমন ধান। আমন ধান মৌসুম আকস্মিক বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আবার পানির ঘাটতির কারণে বোরো ধানের উৎপাদনও লাভজনক নয়। তবুও, কৃষকরা তাদের খাদ্য ও গো খাদ্যের জন্য বোরো ধানের চাষ করতে বাধ্য হয়।  

ধানের তুলনায় বেবি কর্ন এর পানির চাহিদা তুলনামূলকভাবে খুবই কম।  পোকার উপদ্রব এবং রোগের সংক্রমণও এই ফসলে কম থাকে। ফলে বেবিকর্ণের উৎপাদন ব্যয় কম। ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে বেবি কর্ন সংগ্রহ করা যায়। বেবি কর্ন যেহেতু গাছ সবুজ অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়, এর কান্ড ও পাতা গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই গো-খাদ্য সাইলেজের মাধ্যমে ৩-৫ মাস সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এতে চরবাসীদের গো-খাদ্যের  চাহিদা পূরণ হবে। এটি দ্রুত বর্ধনশীল রসালো, স্বচ্ছল, এর ভড়ফফবৎ য়ঁধষরঃু উন্নতমানের, দুষিত পদার্থ মুক্ত (ভৎবব ভৎড়স ঃড়ীরপধহঃং), এবং যে কোনো পর্যায়ে নিরাপদে প্রাণীদের খাওয়ানো যেতে পারে। যা খাওয়ানোর ফলে গরুর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

যেহেতু বেবি কর্ন প্রশস্ত দূরত্বে বপন করা হয়, সেহেতু দুই লাইন বেবি কর্ন এর মাঝে ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। এতে কৃষকরা একই জমি থেকে একই সময়ে থেকে বেবি কর্ন, গো-খাদ্য ও ডাল জাতীয় ফসল অর্থাৎ মোট তিনটি ফসল পেতে পারেন। যেহেতু চরের জমি প্রায় অনুর্বর ডাল জাতীয় ফসল বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন সরাসরি সংগ্রহ করে এবং মাটিতে ছেড়ে দেয়, ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, ডাল জাতীয় ফসল মাটির ক্ষয় হ্রাস করে, আগাছা দমন করে, কীটপতঙ্গ ও রোগ হ্রাস করে, এবং জমি ব্যবহারের দক্ষতা উন্নত করে। সর্বোপরি চর অঞ্চলে টেকসই কৃষির সৃষ্টি হবে। 

সূত্র জানায়, এক একর চরাঞ্চলের জমিতে বেবি কর্ন ফলিয়ে কৃষকের খরচ পড়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। বেবি কর্ন সবজি বিক্রি করে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। সেইসাথে বেবি কর্ন এর প্রায় ২২ টন সবুজ গাছ বা গো খাদ্য পাওয়া সম্ভব।   

শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষিমারি ইউনিয়নের ডাকপাড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ জানায়, তিনি তার জমিতে তিন বছর যাবত বেবি কর্ন চাষ করে আসছে। তিনি জানায়, চরাঞ্চলের এক একর জমিতে বোরো ধানের উৎপাদন খরচ হয় ৪৫ হাজার টাকা । আর এ ধান বিক্রি হয় ৩৬ হাজার টাকা। কৃষকদের এ ফসলে লস হলেও কেবল মাত্র গো খাদ্য খড়ের চিন্তা করে এ বোরো আবাদ করতে বাধ্য হয়। তবে বেবি কর্ন আবাদ করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে অনেক লাভবান হয়েছেন। 

এ ব্যপারে বেবি কর্ন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. আব্দুল কাদের জানায়, চরাঞ্চলের মাটি এ বেবি কর্ন চাষাবাদে খুবই উপযোগী। ধান চাষ করলে যেখানে প্রতিদিন দুই বার পানি দিতে হয়, সেক্ষেত্রে বেবি কর্ন চাষে মওসুমে মাত্র ৩ বার পানি দিলেই হয়। তাই চরাঞ্চলের যেসব পতিত জমি রয়েছে বা অন্য ফসল করে কৃষক কোন লাভের মুখ দেখতে পায় না তাদের জন্য বেবি কর্ন চাষ খুবই লাভ জনক। যদিও এ বেবি কর্নের এখনো পাইকারি ও খুচরা বাজার গড়ে উঠেনি। তবে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন চাইনিজ ও ফাস্টফুড রেস্তোরায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এ বেবি কর্নকে সহজলভ্য করতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় চাইনিজ রেস্তোরার মালিকদের সাথে মতবিনিময় করে এ বাজার তৈরী করা খুবই সহজ। তাই বেবি কর্ন আগামিতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার একটি সবজি বলে মনে করছি। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //