ধর্ষণের পর হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ২ জনের ফাঁসি কার্যকর

দুই বান্ধবীকে ধর্ষণের পর হত্যার ১৮ বছর পর দুই খুনির ফাঁসি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়েছে। গতকাল সোমবার (৪ অক্টোবর) রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে একই সাথে দুইজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন যশোর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাকির হোসেন (অতিরিক্ত দায়িত্ব)। 

যাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তারা হলেন, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার রায়ের লক্ষীপুর গ্রামের আলী হিমের ছেলে মিন্টু ওরফে কালু (কয়েদি নং-৩৬২১) ও একই গ্রামের বদর ঘটকের ছেলে আজিজুর রহমান ওরফে আজিজুল (কয়েদি নং-৩৩০৮)।

তারা আলমডাঙ্গা উপজেলার জোরগাছা হাজিরপাড়া গ্রামের কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগমকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। এ মামলায় তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

যশোর কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা ও কথা বলার ব্যবস্থা করে কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া তাদের পছন্দ অনুযায়ী গত শনিবার গরুর কলিজা ভুনা ও ইলিশ মাছ, রবিবার তন্দুর রুটি, বার্গার ও গ্রিল চিকেন ও সোমবার সাদা ভাত, মুরগির মাংস, দই ও মিষ্টি খাওয়ানো হয়।

কারাগারের রীতি অনুযায়ী ফাঁসির মঞ্চে তোলার আগে দুইজনকে গোসল করানো হয়। এরপর তাদেরকে তওবা পড়ান কারাগার জামে মসজিদের ইমাম আরিফ বিল্লাহ। এর আগে থেকেই ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ফিলিপাইনের তৈরি মেনিলারোপ ফাঁসির দড়ি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুটি ও খুলনা কারাগার থেকে একটিসহ মোট তিনটি আনা হয়। যাতে পর্যাপ্ত ঘি, কলা, ডিম ও মাখন লাগিয়ে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে দণ্ডিতরা শান্ত ও নিরব ছিলেন। তারা হেঁটেই ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন। সময় অনুযায়ী রাত ঠিক ১০টা ৪৫ মিনিটে জল্লাদ কেতু কামাল ও মশিয়ারের নেতৃত্বে লিটু ফকির, আব্দুল কাদের ও আজিজুলসহ পাঁচজন এ রায় কার্যকর করেন।

ফাঁসি সময় উপস্থিত ছিলেন কারা উপমহাপরিদর্শক সগীর মিয়া, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান, যশোরের সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ আবু শাহীন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। 

পরে ময়নাতদন্তের পর রাত ২টার দিকে দুই আসামির পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

ফাঁসি হওয়া মিন্টুর পিতা আলী হিমের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মিন্টু এলাকায় জেলের কাজ করতেন। তার স্ত্রী ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি ছেলের মরদেহ যশোর থেকে নিয়ে যাবার জন্য নিকটতম কয়েকজনকে পাঠিয়েছেন।

অপর দণ্ডিত আজিজুরের বড়ভাই সভা ইসলাম জানান, আজিজুর গ্রামে চাষাবাদ করতেন। এর মধ্যেই এ মামলায় জড়িয়ে পড়েন। তারা আলমডাঙ্গা থেকে ১৩ জন এসেছেন আজিজুরের মরদেহ নিতে। তাদের মধ্যে আজিজুরের স্ত্রী, এক ছেলে (১৮) ও এক মেয়ে (১৫) রয়েছেন।

মামলার সূত্রে জানা যায়, আলমডাঙ্গা থানার জোরগাছা হাজিরপাড়া গ্রামের কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগম ২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর খুন হন। হত্যার আগে তাদের দুইজনকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধের পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলাকাটা হয় ওই দুই নারীর। এ ঘটনায় কমেলা খাতুনের মেয়ে নারগিছ বেগম খুনের পরদিন আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন। 

মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দুইজনসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অপর দুইজন হলেন সুজন ও মহি। মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মহি মারা যান। ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সুজন, আজিজ ও মিন্টুকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট তা বহাল রাখেন। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ দুই আসামির রায় বহাল রেখে সুজনকে খালাস দেন। গত ২০ জুলাই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান সুজন।

এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। যা ৮ সেপ্টেম্বর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। এরপর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সব প্রস্তুতি শেষে সোমবার রাতে রায় কার্যকর করা হয়।

এদিকে ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে কারাগারের সামনে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান ফটকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ফাঁসির খবর শুনে উৎসুক জনতা ভিড় করে কারা ফটকে। তাদেরকে সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

এ বিষয়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর তুহিন কান্তি খান বলেন, সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি একই মঞ্চে জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদসহ কুষ্টিয়া জেলা জাসদের পাঁচ নেতা হত্যা মামলার তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দুইজনকে রাত ১১টা এক মিনিটে, অপর এক আসামির ফাঁসি ১১টা ৪৫ মিনিটে কার্যকর করা হয়। সে সময় যাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছিল তারা হলেন- মিরপুর উপজেলার কুর্শা গ্রামের উম্মত মন্ডলের ছেলে আনোয়ার হোসেন, সিরাজ ওরফে আবুল হোসেনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ও মিরপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন হাবিব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //