অপেক্ষার পালা শেষ, আজ খুলে দেয়া হচ্ছে পায়রা সেতু

শেষ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অপেক্ষার পালা। এখন শুধু ক্ষণগণনা। আজ রবিবার (২৪ অক্টোবর) খুলে দেয়া হচ্ছে বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের নান্দনিক পায়রা সেতুর দ্বার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতুটির উদ্বোধন করবেন। আর মধ্যে দিয়ে পায়রা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হবে। 

সেই সাথে পদ্মার এপারে শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত প্রায় ২১৩ কিলোমিটার সড়কে ফেরিবিহীন সরাসরি নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে। পুরণ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। 

ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যেতে একসময় ১০টি জায়গায় নদী পার হতে হতো ফেরিতে। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ছিল ছয়টি ফেরি পারাপারের পথ। আর ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে বরিশাল পর্যন্ত ছিল চারটি ফেরি পারাপারের পথ। সব জায়গায় সেতু হওয়ার পর বাকি ছিল লেবুখালী ও পদ্মা। লেবুখালীতে আজ সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কাজ শেষের পর্যায়ে। আগামী জুনের মধ্যে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার চিন্তা করছে সরকার।

পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যেতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এখন ফেরিঘাটে জট না থাকলে ১০ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। তবে জট থাকেই। কখনো কখনো ১৫ ঘণ্টায়ও পৌঁছানো যায় না। পায়রা নদী পার হতে যানবাহনকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো।

অপরদিকে, পায়রা সেতুর দ্বার উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও পায়রা সমুদ্রবন্দর- সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। পাশাপাশি বরিশাল বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনা জেলাসহ উপকূলীয় ১০টি অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে বলে মনে করছেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।

কক্সবাজারের পর দেশের বড় সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। শুধু পর্যটন সম্ভাবনা নয়, সেখানে শিল্পায়নের পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। পায়রায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শেরেবাংলা ত্রিমাত্রিক নৌঘাঁটির কাজ চলছে। কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। সবার আশা, আগামী দিনগুলোতে কুয়াকাটায় পর্যটকের সংখ্যা অনেক বাড়বে।

সড়ক বিভাগের তথ্য মতে, বরিশাল জেলার সীমান্ত অর্থাৎ বাকেরগঞ্জ উপজেলার শেষ ও পটুয়াখালী জেলার শুরু দুমকি উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের শুরুর অংশে পায়রা নদীর ওপর অবস্থান পায়রা সেতুর। এ সেতুর উত্তর দিকে ওজন স্কেল ও দক্ষিণ প্রান্তে ইলেকট্রনিক টোল প্লাজা নির্মাণ করা হয়েছে।

বরিশাল প্রান্তে শেখ হাসিনা সেনানিবাস ঘেষা পায়রা সেতু পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা থেকে দূরত্ব প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার। আর বরিশাল নগরীর রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে এর দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। এছাড়া পর্যটন নগরী কুয়াকাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে পায়রা সেতুর অবস্থান।

পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এ সেতুর কিছু বিশেষত্বের মধ্যে একটি হলো সব থেকে ডিপেস্ট ফাউন্ডেশন। সেতুটি ১৩০ মিটার পাইলবিশিষ্ট। যা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর আগে পায়রা সেতু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো পায়রা সেতুতে আমরা ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম চালু করেছি। বিভিন্ন দুর্যোগ বা ওভার লোডেড গাড়ি চলাচলের ফলে ব্রিজের যাতে কোনও ধরনের ক্ষতি না হয়, উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ও বজ্রপাতসহ সেতুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আগেভাগেই এ সিস্টেম সিগন্যাল দেবে। তাছাড়া আকাশ ও নৌপথের কোনও দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সিগন্যাল বাতি জ্বলবে এ সেতুতে। যা দেশের কোনও সেতুতে প্রথম সংযোজন করা হয়েছে।’

সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী সফরে এসে ফোর লেন বিশিষ্ট পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় সেতুর ভৌত কাজের। নাকশাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে নির্মাণ কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়। এসব কারণে কয়েক দফায় বেড়ে সর্বশেষ এ সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। যা শুরুর দিকে আনুমানিক মূল ব্যয়ের সাড়ে তিনগুণেরও বেশি। শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’ সেতু নির্মাণ কাজ করে। এক হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের চার লেনের এই সেতুটি কর্ণফুলী সেতুর আদলে এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে তৈরি। ফলে নদীর মাঝখানে একটি মাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে পায়রা সেতুতে।

এছাড়া ১৭ ও ১৮ নম্বর পিলারের পাইপ ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্য যা দেশের সর্বোচ্চ গভীরতম পাইল। নদীর মধ্যে ও পার্শ্বে থাকা মূল পিলারে যাতে কোনও নৌযান ধাক্কা দিতে না পারে সেজন্য পিলারের পাশে আলাদাভাবে নিরাপত্তা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। পদ্মার থেকেও বড় স্প্যান অর্থাৎ ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি স্পান বসানো হয়েছে এ সেতুতে। তাছাড়া সেতুটি নদীর জলতল থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু। এর ফলে নদীতে নৌযান চলাচলেও কোনও ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলোকিত হবে রাতের পায়রা সেতু।

পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম বলেন, পায়রা সেতু নির্মাণ ও সাজসজ্জার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সেতু রক্ষায় নদী শাসন কাজ শিগগিরই শেষ হবে। তবে সেতুর উদ্বোধনে কোনও বাধা নেই। প্রধানমন্ত্রী রবিবার সেতু উদ্বোধনের জন্য সময় দিয়েছেন। তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবনে থেকে ভার্চুয়ালি সেতুর উদ্বোধন করবেন। 

তিনি বলেন, বরিশাল প্রান্তে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিভাগীয় কমিশনার, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন এবং সড়ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর থেকে পায়রা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //