শহীদজায়া মুশতারী শফীকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল

একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী ও সাহিত্যিক এবং উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি বেগম মুশতারী শফীর মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। 

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আজ বুধবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে মরদেহ আনা হয়। বেগম মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার দেন সিএমপির একটি চৌকস দল। বাদ জোহর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে মুশতারী শফীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

গার্ড অব অনার শেষে মুশতারী শফীর মেয়ে শারমিন শফী বলেন, তার মায়ের ব্যাগে হাতে লেখা একটি শপথনামার সন্ধান পেয়েছেন তিনি। তা পড়ে শোনালে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে উপস্থিত সবাই তার সঙ্গে শপথ নেন।


চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে বেগম মুশতারী শফীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান, কবি আবুল মোমেন, চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, দক্ষিণজেলা আওয়ীলীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ দাশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আবসার, নারীনেত্রী নূরজাহান খান, প্রফেসর রীতা দত্ত,নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, লেখিকা আনোয়ারা আলম, ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, ডা. চন্দন দাশ, বিএফইউজের সাবেক সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, সিউজের সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন শ্যামল, জেলা শিল্পকলা একাডেমী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তি শিল্পী হাসান জাহাঙ্গীর, নাট্যজন সজল চৌধুরী,  প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, সলিমুল্লাহ বাচ্চু, শীলা দাশগুপ্ত, কবি আশীষ সেন, রাশেদ হাসান, রমেন দাশগুপ্ত, প্রণব চৌধুরী, উপস্থাপিকা দিলরুবা খানম, অধ্যাপক বেণু কুমার চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুল দাশ গুপ্ত। 

এছাড়াও উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টি, সনাক, বোধন, প্রমা, খেলাঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মহিলা কলেজ, বাসদ, জেলা শিল্পকলা, সিআরবি রক্ষা মঞ্চ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, নারী যোগাযোগ কেন্দ্র, ফুলকি, বিটা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, যুব ইউনিয়ন, বিজয় মেলা পরিষদ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, শব্দনোঙর আবৃত্তি সংগঠন, দেশচিন্তা, বিজয়৭১, সাহিত্য পাঠচক্র, জয়বাংলা শিল্পীগোষ্ঠী, অগ্নিবীণা পাঠাগার, গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লাস্ট, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সঙ্গীত ভুবন, বিপ্লবী তারেকশ্বর স্মৃতি পরিষদ শ্রদ্ধা জানায়।


গত সোমবার (২০ ডিসেম্বর) ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেগম মুশতারী শফী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৩ বছর বয়সী বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়া বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগও ছিল। 

চিকিৎসার জন্য গত ২ ডিসেম্বর তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে রাজধানীতে মেয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় মুশতারী শফীকে। এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর শারীরিক অবস্থার আবার অবনতি হলে সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। 

এরপর তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার তিনি মারা যান।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বেগম মুশতারী শফীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে। সেখানে জানাজা শেষে নগরীর চৈতন্য গলি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্বামী মোহাম্মদ শফী ও ছোট ভাই এহসানকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তার পরিবার একাত্তরে চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোসময় তিনি ওই বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ষাটের দশক থেকে তিনি নারী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে তিনি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি তিনি এতে নেতৃত্বও দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রয়াণের পর দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মূল নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি।

এছাড়া বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একযুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার বেগম মুশতারী শফী দেশে প্রগতিশীল চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য তাকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০১৬ সালে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করা হয়।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //