অসহায়-দুঃস্থদের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য নজির আয়েশার

সালটা ২০০৮ এর দিকে। অচেনা মোবাইল নাম্বার থেকে একটা ফোন কল আসলো, মাদারীপুর পুরান বাজার পতিতা পল্লীতে একটা ১৪ বছরের কিশোরীকে অপহরণ করে আনা হয়েছে। জোর করে বাধ্য করা হচ্ছে যৌন কাজ করার জন্য। এমন ফোনকল পাওয়া মাত্রই ছুটে গেলেন যৌনপল্লিতে। ফোন দিলেন থানায়। প্রশাসন ও নিজ চেষ্টায় উদ্ধার করলেন কিশোরীকে। ফিরিয়ে দিলেন তার পরিবারের কাছে। 

শুধু এই ঘটনাই নয়, মাদারীপুরের প্রায় দুই শতাধিক কিশোরী মেয়েদের বাল্যবিবাহের করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করেছেন। সাথে অসংখ্য অসহায় দুঃস্থদের পাশে দাঁড়িয়ে যিনি মানবতার এক অনন্য নজির গড়েছেন। তিনি মাদারীপুরের নারী জাগরণের অগ্রদূত আত্মপ্রত্যয়ী নারী সাংবাদিক আয়েশা সিদ্দিকা আকাশী। নারী সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাত থেকে পেয়েছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক-২০১৯।

মাদারীপুরের শহরতলি হাজির হাওলা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। পিতা আনিসুর রহমান ও মা তাহমিনা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। পড়াশোনা করেছেন চরমুগরিয়া মহাবিদ্যালয় কলেজে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করেন কবিতা চর্চা। কবিতা চর্চ্চার মধ্যে পরিচয় ঘটে নানা সামাজিক সংগঠনের কর্মীদের সাথে। আসলেন সাংবাদিকতায়। 

২০০৩ সালে মাদারীপুর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘সুবর্ণগ্রাম’ পত্রিকায় কবিতার পাশাপাশি লেখা শুরু করেন প্রবন্ধ-ফিচার। পরবর্তীতে কাজ করেন জাতীয় দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায় মাদারীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর সুযোগ পান অন্য আর একটি জাতীয় পত্রিকায় কাজ করার। তিনি দীপ্ত উদ্যোমে শুরু করেন তার পথচলা।

সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিএ ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মার্স্টাস শেষ করেন। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ের উপর ডিগ্রী নেন। পড়াশুনার পাশাপাশি চলতে থাকে তার সাংবাদিকতা। অনেক বাধা-অন্তরায়। কখনো হুমকি-ধামকি। মাঝে মধ্যে কর্তাব্যক্তিদের টেলিফোন। কিছুই তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আয়শা পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবিচল।

জেলা সদর মাদারীপুরসহ উপজেলাগুলোতে দৈনিক সুবর্ণ গ্রামের বার্তা সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে আয়শার নাম ছড়িয়ে পড়ে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান নারী সাংবাদিক হিসেবে। ছোট বেলা থেকে বই পড়া ও সংগ্রহ করা সখ তার। তার সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য সংখক বই রয়েছে। সেই সাথে বর্তমানে তিনি হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগ্রহ করছেন বিভিন্ন ধরণের বিলুপ্ত নানা জিনিসপত্র। যেমন: হারিয়ে যাওয়া ঢেকি, যাতা, পিতলের জিনিসপত্র, এনালক ক্যামেরা, হারিকেন, ল্যাম্ব, সাদাকালো টেলিভিশন ইত্যাদি তার সংগ্রহে আছে। হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো যাতে করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, সেই জন্য নিরবে তিনি ও তার স্বামী রাজন মাহমুদ সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।

২০০৮ সালে ২১ শে বই মেলায় কর্ণেল খলিলুর রহমানের সহযোগিতায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন থেকে ‘এক জলকন্যার রির্পোটের শিরানাম’ নামে একটি কবিতার বই বের হয়। বইয়ের জন্য গাংচিল সাহিত্য পরিষদ থেকে পান পদক, গল্প লেখার জন্য পান সুনীল সাহিত্য বিশেষ পুরস্কার ও মাদারীপুর জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হবার জন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘মাত্রা’ তাকে দেন বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার।

এছাড়াও ২০১১ সালে জেলায় সফল নারী হিসেবেও তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হয়। এতে আয়েশার উদ্দম্য বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মনের সাহস ও উদ্দীপনা। অনেকের মধ্যে পরিচয় হয় পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অভ নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজনের সাথে। শুরু হয় পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন কাজ। একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘আমরাই পারি’ এর। কাজের পরিধি বেড়ে গেলে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কনার সহযোগিতায় নিজেই প্রতিষ্ঠিত করেন নকশি কাঁথা নামের একটি নারীবাদী সংগঠন। জেলায় নানা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সংবাদ করে খুব অল্প বয়সেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন একজন নারী নেত্রী হিসেবে। তিনি জেলার অনেক গরিব দুখীদের পাশে দাড়িয়ে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। তাকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় নানা সমস্যার। একজন নারী হিসেবে নানা প্রতিকূলতাকে পাড় করেছেন তবুও তিনি থেমে নেই। 

২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বিয়ে করেন মাদারীপুর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অভ নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজনকে। বিয়ের পর কাজের অনুপ্রেরণা ও পিছনের মানুষ হিসেবে রাজন সব ধরণের সহযোগিতা করে আসছেন।

দৈনিক সুবর্ণগ্রাম পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর পূর্বাপেক্ষা তার দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় সে আরো সর্তক ও নিষ্ঠাবান হয়ে উঠে। শুরু করেন দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা। তার দৃঢ় প্রত্যায় ছিল ছেলে (পুরুষ) পারলে সে কেন একজন নারী হয়ে পারবেন না। তাকে পারতেই হবে। আর সেই সব নিন্দুক মানুষদের পিছনে ফেলে ২০১৯ সালের কালের কণ্ঠ শুভসংঘ এর পক্ষ থেকে সেরা সংগঠন হিসেবেও পুরস্কার পান। সেই সাথে মাদারীপুর জেলা শহরের সবাই তাকে চেনে-জানে একজন সৎ সাহসী সাংবাদিক হিসেবে। 

‘বাশপাতা ও স্বীকারোক্তি’ নামের দুইটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকসহ একাধিক ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক আয়শা। তিনি জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। অর্জন করেছেন স্কয়ার গ্রুপের রাধুনি কীর্তিমতী সম্মাননা (নারী সাংবাদিকতা)। আরো পেয়েছেন ভাষাসৈনিক মিলনমেলায় নারী সাংবাদিকতায় উৎসাহ পদক, প্রাণ চাটনি জীবনের গল্পের আয়োজনে নারী সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের পক্ষ থেকে জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হিসেবে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা, মাদারীপুর জেলা তথ্য অফিসের আয়োজনে জেলার সেরা ২০টি ছবির প্রদর্শণ করে পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার, সুনীল সাহিত্য পুরস্কার, জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হবার জন্য আবৃত্তি সংগঠন মাত্রা দিয়েছেন বিশেষ সম্মাননা, গাংচিল সাহিত্য পদক (কবিতার বই এর জন্য) প্রমুখ।

এছাড়াও তিনি মাদারীপুরের নানা সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, নারী উন্নয়ন সংস্থা নকশি কাঁথা নামের একটি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক, মাদারীপুরে পরিবেশবাদী সংগঠন ’ফ্রেন্ডস অব নেচার’র যুগ্ম সম্পাদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গাংচিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ও  দক্ষিণ বাংলা সাহিত্য পরিষদ সদস্য, জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম’র কার্যকরী কমিটির সদস্য, মাদকবিরোধী সংগঠন ‘মানস’র কার্যকরী কমিটির সদস্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর কার্যকরী সদস্য, এমএম হাফিস মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরীর কার্যকরি সদস্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) সদস্য প্রমুখ।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি মাদারীপুর জেলায় গরীবের বন্ধু হিসেবেও পরিচিত লাভ করেছেন। গরীব দুখী ও অসহায়রা তাদের আর্থিক সমস্যাসহ নানা সমস্যা নিয়ে ছুটে যান আয়শার কাছে। তিনি এইসব অসহায় মানুষের দুঃখের কথা শুনে তা যাচাই করে সত্যতা পেলে নিজ নামের ফেসবুকে তুলে ধরেন। তা দেখে মাদারীপুর, ঢাকাসহ দেশের বাহিরে ইতালী, সৌদি আরব, কুয়েত, মালোশিয়াসহ অসংখ্য বন্ধু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে তা ওইসব অসহায় মানুষদের দেন।

শুধু মাদারীপুর জেলায় নয়, ফেসবুকের অসংখ্য চেনা-অচেনা বন্ধুর কাছে আয়শা একজন বিশ্বস্ত মানুষ, গরীবের বন্ধু। ইতিমধ্যে তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তিন শতাধিক পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। 

সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পা বিছিন্ন কিশোরী, মাদারীপুর সদর উপজেলার হুগলীর আদিত্যপুর গ্রামের শাজাহান খোয়াজের মেয়ে শুভ আক্তারকে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য তার মা ফরিদা বেগমের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন। সেই টাকা দিয়ে কিশোরী শুভ কৃত্রিম পা লাগিয়েছে।

দুর্ঘটনায় দুটি পা হারিয়ে আব্দুল হকের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এই যুবক বয়সে দুটি পা বেচে দুটি কৃত্রিম পা লাগিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর পর ওই কৃত্রিম পা দুটি নষ্ট হয়ে যায়। পড়তে হয় তাকে নানা সমস্যায়। কিন্তু টাকার অভাবে পুনঃরায় পা বানাতে পারছিলেন না। অনেক কষ্ট করে ২৫ হাজার টাকা জোগার করলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। প্রয়োজন ছিল আরো টাকার। খোজ পেয়ে তিনি আসেনর কাছে। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন। ৬০ হাজার টাকা তুলে দেন মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি গ্রামের সলেমান মাতুব্বরের ছেলে মো. আ. হকের হাতে। সেই টাকা দিয়ে সে পা লাগিয়েছেন।

এছাড়াও মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি ইউনিয়নের ৯০ বছরের বৃদ্ধ মো. হাকিম উদ্দিন বয়সের ভারে হাটতে না পারলেও বাচার তাগিদে তাকে ভিক্ষা করতে হতো। ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে হাকিম উদ্দিনকে দুই বছর পর্যন্ত চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস প্রতি মাসে কিনে দেয়া হতো। তিনি মারা যাবার পারও তার স্ত্রীকে প্রায় এক বছর সহযোগিতা করা হয়েছে। অসহায় শিশুকে দুধ কিনে দেন, স্বাবলম্বী হবার জন্য প্রায় অসংখ্য জন নারীকে সেলাই মেশিন কিনে দেন, অসহায় প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার কিনে দেন, অসহায় শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেন, চিকিৎসার জন্য অনুদান, ৫ বছর ধরে প্রতি ঈদের অসহায় প্রতিবন্ধী, দুস্তদের নতুন জামা বিতরণ, কম্বল বিতরণ ও শীতের সময় মানবতার দেয়াল শিরোনামে সহযোগিতা করা হয়।

আয়েশা সিদ্দিকা আকাশী জানান তার স্বপ্নের কথা। তার ইচ্ছে একটা বুটিক হাউজ করবেন, সেখানের লাভের একটা অংশ দেয়া হবে অসহায় মানুষদের। সেই সাথে স্বপ্ন আছে নারীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলার। সেখানে অসহায় নারীরা এসে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী থাকতে পারবেন। যেমন প্রত্যান্ত এলাকা থেকে শহরের কোনো কাজে বিশেষ করে অসহায়-নির্যাতিত নারীদের আইনের সহযোগিতা ও চিকিৎসার জন্য মাদারীপুরে আসতে হয়। কিন্তু কোনো কারণে তাদের রাত হলে কিংবা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন হয়, কিন্তু তাদের জন্য তেমন কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই। তাই ওইসব নারীরা যেন নিরাপদে নারী আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারবে, এমন একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ইচ্ছা আছে। 

আয়েশা বলেন, মানুষকে সাহায্য করার প্রবল ইচ্ছা থেকেই এখন নেশা হয়ে গিয়েছে। মানুষের পাশে থেকে যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই তার থেকে যে ভালবাসা পাই এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। আমি চাই জীবনের শেষ দিন অবধি এভাবেই মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করব। 

মাদারীপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কনা বলেন, মাদারীপুরে যদি কেউ নারী আর শিশুদের জন্য ভেবে থাকেন সেটা আকাশী। শুধু নারী নয় সে অসংখ্য অসহায় মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে। তার মধ্যে যে সততা আছে সেটা আসলেই নজীর সৃষ্টি করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //