মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস : ঘুষ না দিলে সেবা পেতে হয়রানি

মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারী আর দালালরা মিলে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সেবাপ্রার্থীরা সহজে  কোন পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। সেবাপ্রার্থীরা হয়রানি এড়াতে বাধ্য হয়ে দালালদের মাধ্যমে বাড়তি টাকা ঘুষ দিয়ে সেবা নিচ্ছেন। দালালদের কাছে পরিশোধ করা ঘুষের বাড়তি টাকা চলে যাচ্ছে অফিস কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের পকেটে।

অভিযোগ রয়েছে, পাসপোর্ট অফিসের সুপারিন্টেনডেন্ট জগদীশ চন্দ্র তাতী, উচ্চমান সহকারি ফজলেন্দার টুকটুকি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো: ইসমাইল সরকার, রেকর্ড কিপার রোকসানা ইসলামসহ অফিস কর্মচারী ও আনসার সদস্যরা দালাল চক্রের কাছ থেকে অর্থের সুবিধা নিয়ে থাকেন। 

মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কার্যালয় ঘুরে সাম্প্রতিক দেশকালের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের সামনে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান। এসব কম্পিউটারের দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের সাথে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এসব কম্পিউটারের দোকান ছাড়াও রয়েছে একাধিক দালাল সদস্য। এসব দালালরা সেবা প্রার্থীদের কাছ থেকে অনলাইন আবেদন ফি, ব্যাংক ড্রাফট, পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদে পাসপোর্ট অফিসের ঘুষের জন্য এক হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। এ ঘুষের টাকা পাসপোর্ট অফিসে পরিশোধ করা হলে সেবাপ্রার্থী সহজেই হয়রানি ছাড়া সেবা পান। প্রতিটি ই-পাসপোর্টের ঘুষের এক হাজার থেকে পাঁচশো টাকা চলে যায় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক নাহিদ নেওয়াজের পকেটে। আর বাকি পাঁচশো টাকা অফিসের কর্মচারী থেকে শুরু করে নির্ধারিত হারে আনসার সদস্যদের পকেটে যায়। তবে বড় ধরণের কোন ভুল থাকলে নির্ধারিত এক হাজার টাকার বাইরে আরো টাকা দিতে হয়। কেউ নিজে থেকে অনলাইনে আবেদন করে অফিসে জমা দিতে গেলে ভুল ধরা থেকে শুরু করে নানা টালবাহানা করেন অফিস কর্তা ব্যক্তিরা। অনেক চেষ্টার পর কেউ নিজ উদ্যোগে আবেদন জমা দিয়ে ছবি তুলতে পারলেও পাসপোর্ট ডেলিভারি পেতে ভোগান্তিতে পড়েন। ফলে এসব হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আর দালালদের কাছ থেকে বাড়তি ঘুষের টাকার আশায় কর্মচারীরাও সেবাগ্রহীতাদের সাথে নানা টালবাহানা করেন।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান হলে দালালরা অফিস স্টাফদের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সব কাজ করেন। পছন্দের সেবাপ্রার্থী গেটে প্রবেশের সাথে সাথে তার নাম, চেহারার ধরন, জামা কাপড়ের রংসহ সকল বর্ণনা মোবাইলে অফিসে জানিয়ে দেন। প্রশাসনের নজরদারি কমে গেলে বা সেবাপ্রার্থীর জরুরি প্রয়োজনে তখন দালালেরা নিজেরাও অফিসে যাতায়াত করে থাকেন। 

সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়নের গোলড়া গ্রামের সাইদুল ইসলাম বলেন, আমার আগের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় অনলাইনে আবেদন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে যাই। দালাল দিয়ে কাজ না করায় এ অফিসের গেট থেকে শুরু করে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছি। আমার ভোটার আইডি কার্ড থাকলেও স্মার্ট কার্ড না থাকায় নতুন পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানায়। অনেক হয়রানির পর ফিঙ্গার ও ছবি তোলার সুযোগ পাই। তবে নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও আমার পাসপোর্ট হাতে পাইনি। পাসপোর্ট পেতে কয়েক মাস দেরি হবে বলে তারা জানায়। পরে বাধ্য হয়ে অফিস থেকে বের হয়ে দালালের শরণাপন্ন হই। দালাল অফিসের সাথে যোগাযোগ করে পনেরশো টাকার বিনিময়ে মাত্র একদিনে পাসপোর্ট ডেলিভারি করিয়ে দেয়। 

সিংগাইর উপজেলার জয়মন্টপ এলাকার এখলাস মিয়া বলেন, মেয়েকে বিদেশ পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করতে হচ্ছে। নিজেরা এলে হয়রানি হয়। তাই এলাকার একজন দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়েছি। সাধারণ পাসপোর্টের জন্য দালালকে ৬ হাজার পাঁচশো টাকা দিয়েছি। দালাল পাসপোর্ট অফিসের লোকদের ফোন করে সব বলে দেওয়ায় কোন সমস্যা হয়নি।

মো: সোলায়মান বলেন, পাসপোর্ট অফিসের হয়রানির বিষয়ে কোন অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়ে আরো হয়রানির শিকার হতে হয়। আর অনেকে ভয়েই লিখিত অভিযোগ দেন না। এসব ঘটনা অফিসের বড় অফিসার জানার পরও কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। ফলে ঘুষ ছাড়া পাসপোর্টও মিলে না। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট করতে গেলে অফিসের লোকেরা ছোটখাটো ভুল ধরে ফেলে। এছাড়া অনেক সময় তাদের হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হয়। ফলে সেবা গ্রহীতারা আমাদের কাছে আসে। পাসপোর্টের মেয়াদ, সাধারণ ও জরুরি অনুযায়ী ব্যাংক ড্রাফট ও পাসপোর্ট অফিস খরচ রাখি। সব ঠিক থাকলে পাসপোর্ট অফিসে এক হাজার টাকা দিতে হয়। অফিসের বড় কর্তা পাঁচশো টাকা রাখেন আর বাকি পাঁচশো স্টাফদের মাঝে নির্ধারিত হারে ভাগ হয়ে যায়। তবে বড় কর্তা আমাদের হাত দিয়ে টাকা লেনদেন করেন না। আমরা অফিস স্টাফদের টাকা দেই। আর  বিশ্বস্ত অফিস স্টাফরা বড় কর্তাকে টাকা দেয়। আর কোন পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোন ঝামেলা থাকলে সেগুলো কন্টাক অনুযায়ী টাকার অংক বেড়ে যায়। ব্যাংক ড্রাফট ও অফিস খরচের পর কিছু টাকা আমাদের থাকে। আমাদের চেয়ে অফিস কর্তাদের বেশি লাভ। প্রতিজন দালাল দিনে ৩/৪ টি পাসপোর্টের কাজ পান। কোনদিন অনেকেই কোন কাজ পান না। তবে প্রতিদিন প্রায় প্রতি পাসপোর্ট থেকেই অফিসের লোকজন টাকা পেয়ে থাকেন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন কচি বলেন, পাসপোর্ট অফিসের হয়রানি কমাতে শুধু দালালদের দোষারোপ করলে হবে না। অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজন হলে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাদা পোষাকে অনুসন্ধান করে অভিযান পরিচালনা করা উচিত।

পাসপোর্ট অফিসের সুপারিন্টেনডেন্ট জগদীশ চন্দ্র তাতী, উচ্চমান  মান সহকারী ফজলেন্দার টুকটুকি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. ইসমাইল সরকারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও ফোন রিসিভ করেননি।

রেকর্ড কিপার রোকসানা ইসলাম বলেন, আমি নিজে অসুস্থ। এসব বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বলেন। 

এসব বিষয়ে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক নাহিদ নেওয়াজ বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১২ হাজার আবেদন জমা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দশ হাজার পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পাসপোর্ট থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। এছাড়া মৌখিক অভিযোগ পাওয়ার পর কর্মচারীদের সতর্ক করা হয়। কাদের সতর্ক বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে তথ্য তিনি জানাতে রাজি হননি। 

জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, দালাল চক্রটি বন্ধ করতে বিভিন্ন সময় অভিযান হয়েছে। দ্রুত এ চক্রটি বন্ধ করতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। যদি এসব কার্যক্রমের সাথে পাসপোর্ট অফিসের কেউ জড়িত থাকেন তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //