ক্লান্ত চালকের ‘ঘুমভাবে’ প্রাণঘাতী সংঘর্ষ

ঢাকা থেকে দিনে ছেড়ে যাওয়ার পর আবার রাতেই ঢাকায় ফিরে আসছিল ৩ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ চালক নিহতের ঘটনায় দায়ী সেই বাসটি। দীর্ঘ সময় যাতায়াতের কারণে বাসটির চালক বারবার ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। একপর্যায়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের বলিয়াপুর এলাকায় এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে বাম পাশের একটি বাসকে বাড়ি দিয়ে এরপর ডানপাশে ট্রাককে ধাক্কা দেয়। সবশেষ সেটি ধাক্কা দেয় অপর লেনের বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কর্মকর্তাবাহী বাসে। এ ঘটনায় ওই বাসের চালকসহ ৪ জন মারা যান। এরপর থেকেই ঘাতক সেফ লাইন পরিবহণের চালককে খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে গতকাল জানা যায়, ঘটনার দিন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যায় ঘাতক বাসের চালকও।

এবার খোঁজ মিলেছে বাসটির সহকারীর। সেদিন দুর্ঘটনার সময় ছিটকে পড়ে যাওয়ার পর স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। মো. তানভীর নামের ওই সহকারী জানিয়েছেন দুর্ঘটনার আগের কথা।

তিনি বলেন, নিউ গ্রিন এক্সপ্রেসের ব্যানারের ওই বাসে আমি এক ট্রিপের জন্যে হেল্পার হিসেবে কাজ নেই। শনিবার দিন ঢাকা থেকে বাসটি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় যায়। পরে রাতেই আবার ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। বাসে অনেকজন যাত্রী ছিলেন। সকালের দিকে সাভারের দিকে পৌঁছায়।  পুরো যাত্রাপথেই চালক মারুফ বারবার ঘুমিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে ডেকে সজাগ করছিলাম। এরমধ্যে বলিয়াপুরে আসার পর ডানে নিতে বলতে বলতেই বাম পাশের একটি বাসকে বাড়ি দেয় আমাদের বাস। এরপর ডানে ধাক্কা দেয় আরেকটি ট্রাককে। তখনই আমি ছিটকে পড়ে যাই। তখনও যাত্রীদের তেমন ক্ষতি হয়নি। ওই সময় আমাকে কয়েকজন ধরে পিকআপে তুলে হাসপাতালে পাঠায়।

এদিকে এ ঘটনায় কথা হয় নিহতের পরিবারের সাথেও। মারুফের মা জানান, রবিবার ওই দুর্ঘটনার পরপরই খবর পেয়ে আরেক ছেলেকে নিয়ে বলিয়ারপুরে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে থাকা লোকজনকে মারুফের পোশাকের বর্ণনা দিলে তারা জানান এমন একজনকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে মারুফকে মৃত অবস্থায় পাই। পরে মরদেহ নিয়ে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে মরদেহ দাফন করা হয়।

মারুফ হোসেনের বাবা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, আমার ছেলে আগে পিকআপ চালাতো। হঠাৎ একজন ফোনে বললো এই ছেলে (মারুফ) কে হয় আপনার। এই ছেলে এক্সিডেন্ট করছে। তখন আমি জিজ্ঞেস করছি পিকআপে? তখন বলে না সেইফ লাইনের গাড়ি। এরপর তো শুনি মারা গেছে। সে মারা গেছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার পোলায় তো এলাকায় পিকআপ চালাতো। আমি তো চাইনি বাস চালাক। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কিছুদিন আগে ইকবাল (বাস মালিক) বাসের ড্রাইভার বানাইলো। ইকবাল মিয়ার বাড়ি বরিশাল। ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডে জব্বার হাউজিংয়ের ৫ তলায় থাকে। আমি তাঁর নামে মামলা করবো।

তিনি বলেন, আমিও সেইফ লাইনের গাড়ি চালাইতাম। আমার বাড়ি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। আমার বাবা পুলিশের হাবিলদার ছিলো। আমার বাবার আসল বাড়ি চাঁদপুরে। 

নিহতের মা শামসুন্নাহার বলেন, আমার স্বামী ফোনে বলে ছেলে বলিয়ারপুরে এক্সিডেন্ট করছে। আমি ছোট ছেলেকে সাথে করে সেখানে যাই। আমার ছেলের সাদা চেক শার্ট ছিলো এটা শুনে সেখান থেকে একজন বলে আমার ছেলেকে সোহরাওয়ার্দীতে নিয়েছে। তখন জ্যাম ঠেলে সোহরাওয়ার্দীতে যাইতে যাইতে আমার ছেলে গিয়ে দেখি মারা গেছে। তখন বারোটা সাড়ে বারোটা বাজে। হাসপাতালে যারা কাজ করে তারা বললো এই ছেলে মা মা কইতে কইতে মারা গেলো।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার বাসায় ইকবাল (বাস মালিক) আইসা পটাইয়া ছেলেরে গাড়ি চালানোর জন্য নিছিলো। এক্সিডেন্টের পর মালিক কিছু করে নাই। হাসপাতালে নেয় নাই। খবরও পর্যন্ত দেয় নাই। ফোন পর্যন্ত ধরে নাই। তার কারণে আমার ছেলে মারা গেলো। ইকবাল যে এত বড় বেইমানি করলো আমরা মামলা দিমু ওর নামে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা বলেন, গতকাল সন্ধ্যার পর আমরা জানতে পারি রাজধানীর শেরে বাংলা থানা পুলিশ প্রাথমিক সুরতহাল করে মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

গত রবিবার (৫ জুন) সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের বলিয়াপুর এলাকায় সেইফ লাইনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে বিভাজন টপকে পরমাণু শক্তি কমিশনের বাস ও একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান আরিফ, পূজা সরকার, কাউসার রাব্বি ও সংস্থাটির বাসের চালক রাজিব হোসেন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন ৩০ জন। এ ঘটনায় সাভারে হাইওয়ে থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। এতে ওই বাসচালককে প্রধান আসামি করা হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //