ঘরের পাশে শায়িত তিনজন, ভালো আছে সেই নবজাতক

ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় একই পরিবারের তিনজন (স্বামী, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও মেয়ে) নিহতের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। গতকাল শনিবার (১৬ জুলাই) রাতে জানাজা শেষে উপজেলার রায়মণি এলাকার নিজ বাড়িতে ঘরের পাশে তাদের দাফন করা হয়। অপরদিকে দুর্ঘটনায় মৃত অন্তঃসত্ত্বার নবজাতক নগরীর চরপাড়া এলাকায় লাবীব প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থা ভালো বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

আজ রবিবার (১৭ জুলাই) সকালে রায়মণি ফকির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের পেছনে একসাথে নতুন তিনটি কবর। যেখানে শায়িত আছে দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী রত্না আক্তার ও মেয়ে সানজিদা আক্তার। একসাথে তিনজনকে হারিয়ে তাদের কবরের পাশে বসেই অনবরত বিলাপ পাড়ছিলেন মা সুফিয়া আক্তার। আর বাকরুদ্ধ বাবা মোস্তাফিজুর রহমান। বাবা-মা-বোনকে খুঁজছেন জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির ১০ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত ও সাত বছর বয়সী ছেলে এবাদত। 

অথচ নতুন শিশুর আগমনে এই বাড়িতে থাকার কথা ছিলো আনন্দ-উচ্ছ্বাস। একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে সবকিছু, আনন্দের সময়টাকে পরিণত করেছে বিষাদে। এমন ঘটনায় শোকে স্তব্ধ শুধু রায়মণি গ্রামই নয় শোকের ছায়া নেমে পুরো ত্রিশাল উপজেলাজুড়ে। 

নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও মা সুফিয়া আক্তার দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারা জানান, ২০০৪ সালে তাদের ছোট ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। এবার বড় ছেলে, তার স্ত্রী ও নাতনীকে সড়কে প্রাণ দিতে হয়েছে। এতো কষ্ট কাটিয়ে ওঠার না। সবাই নবজাতকের খোঁজ খবর নিলেও কেউ বাকি দুই সন্তানদের খোঁজ নিচ্ছে না। সন্তানদের নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

এদিকে মৃত মায়ের গর্ভ ফেটে জন্ম নেয়া নবজাতক কন্যা শিশুকে এক নজর দেখতে হাসপাতালে ভিড় জমাচ্ছেন অনেকে। গত শনিবার রাত আটটার দিকে হাসপাতালে গিয়ে নবজাতককে দেখে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামূল হক বলেন, একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের সবাই মারা গেলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে নবজাতকটি। তার চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার জেলা প্রশাসন থেকে করা হবে। যেকোনো প্রয়োজনে শিশুটির পাশে থাকা হবে।

বাংলাদেশ কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ও নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, নবজাতকটি পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। তার ডান হাতের দুই জায়গায় হাড় ভেঙে গেছে। তবে এটি বড় ধরণের কোনো ক্ষত না। সার্বক্ষণিক শিশুটিকে চিকিৎসার মধ্যে রাখা হয়েছে।

লাবীব প্রাইভেট হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ত্রিশালে দুর্ঘটনার পর সেখান থেকে খবর পেয়ে শিশুটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। শিশুটির বাবা জাহাঙ্গীর আমার পূর্ব পরিচিত। তাই শিশুটিকে আমার হেফাজতে রেখেছি।

তিনি আরো বলেন, শিশুটির সমস্ত খরচ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বহন করছেন। শিশুটি যতদিন না পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে ততদিন পর্যন্ত তার পড়াশোনা, চিকিৎসাসহ সমস্ত খরচ ওই ব্যক্তি দিবেন।

এর আগে, শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ত্রিশালের কোর্টভবন এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগম (৩২), তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) এবং তাদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা নিহত হন। এসময় অলৌকিকভাবে মায়ের গর্ভ ফেটে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে এক সুস্থ নবজাতক। ভূমিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় পড়ার সাথে সাথে ছুটে যায় পুলিশ ও আশপাশের লোকজন। পরে নবজাতকটিকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নেওয়ার পরই জানা যায় জীবিত আছে নবজাতক কন্যাটি।  

সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য নবজাতকটিকে ময়মনসিংহ সদরের সিবিএমসিবি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে এক্সরে রিপোর্টে জানা যায় তার ডান হাতের দুইটি হাড় ভেঙে গেছে। বর্তমানে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে নগরীর লাবীব হাসপাতালে সদ্যজাত শিশুটি চিকিৎসাধীন রয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //