ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু: অ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট করেন অস্ত্রোপচার

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগমের পক্ষে নানাভাবে সমঝোতার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় একটি মহল। এদিকে, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি ডাক্তার সানজিদা পারভীনকে আহবায়ক করে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এরইমধ্যে, অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে চমকপ্রদ বেশ কিছু তথ্য।

নিহত শিরিন বেগম স্বামী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত রবিবার (২১ আগস্ট) সকাল থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে জনসেবা হাসপাতাল যাই। সেখানে কোন ডাক্তার না থাকলেও হাসপাতালের এক নার্স রোগীর কাগজপত্র দেখে বলে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করা যাবে। আপনি রোগী নিয়ে আসেন। এরপর মাসুদ নামে এক চিকিৎসককে মোবাইলে কল করে ডেকে আনেন তিনি। তারা ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সময় ধরে সিজার করেন। এ সময় রোগীর জন্য এবি পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন জানিয়ে তারা রক্ত সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেন। 

তিনি আরো বলেন, চিকিৎসকের কথা অনুসারে, দুজন রক্তদাতা সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে একজন আমার শ্যালক ও আরেকজন ভাগনে। শুরুতে শ্যালকের কাছ থেকে এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরো এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়লে আমার ভাগনের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে তাকে হাসপাতালের বেডে শোয়ানো হয়। এরইমধ্যে আমার স্ত্রীর গায়ে ওই হাসপাতালের নার্স শামীমা বি পজেটিভের রক্ত পুশ করেন। রক্ত চলা অবস্থায় রোগীর খিঁচুনি শুরু হয়। এসময় ছুটে গিয়ে দেখি রোগীর রক্ত চলতে। কিন্তু ওই দিকে রক্তদাতা ভাগনে রক্ত দিতে বেডে শুয়ে আছে। বি পজিটিভ রক্ত চলার কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের ল্যাব সহকারী শাওন মিয়া ছুটে এসে জানান, এতে কোনো সমস্যা হবে না। পরে আস্তে আস্তে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে এ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার উত্তরার সিএম হাসপাতালে পাঠায়। 

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ওই রাতে সিএম হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, জনসেবা হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আর মাসুদুর রহমান মাসুদ একজন অ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিষ্ট। তিনি কোনো সার্জন নন। কিন্তু তিনি নিজেই করেছেন রোগীর সিজার। শুধু জনসেবা হাসপাতাল নয় স্থানীয় অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে ডাকা হলে তিনি সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করে থাকেন।

আরো জানা গেছে, অ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিষ্ট মাসুদের স্ত্রী শামীমা জাহান নূপুর একজন গাইনি ডাক্তার। আর রোগীর কাগজপত্রে সিজারিয়ান চিকিৎসক হিসেবে ব্যবহার করা হয় অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক মাসুদের স্ত্রীর নাম। আর অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক হিসেবে মাসুদুর রহমানের নাম। তবে হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনদিনও এই হাসপাতালে সিজার করতে আসেননি গাইনি ডাক্তার শামীমা জাহান নূপুর। অন্যদিকে, আলট্রাস্নোগ্রাফি করার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ঘটনার দিন তিনিই অল্ট্রাস্নোগ্রাফি করেন সহকারী আশিকুর রহমান। শুধু এটা নয়, তিনি নিয়মিতই এ হাসপাতালে আল্ট্রাস্নোগ্রাফি করেন।

স্থানীয়রা জানান, কিছুদিন আগে হাইকোর্টের নির্দেশ দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাভিযান পরিচালনা করা হয়। তারপরও কেনো জনসেবা হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়ে যাওযার পরেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখার দায়িত্ব কার? সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (ইউএইচএফও) দেখার কথা ছিল।

ঘটনার দুদিন পর গতকাল মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) দুপুর দেড়টায় সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও চিকিৎসক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে বক্তব্য নিতে তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোন একাধিকবার ফোন দিয়ে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।

থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনিসুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেননি। অভিযোগ না করা হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মনজুর-ই-এলাহী (ইউএইচএফও) বলেন, এ ব্যাপারে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //