‘এ দুঃখ দেখার কেউ নাই’

হতাশ চা-শ্রমিকরা

চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার (২৭ আগস্ট) চা বাগান মালিকদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পর এ ঘোষণা আসে। ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণায় বেশিরভাগ চা শ্রমিক হতাশ হয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে চা শ্রমিকরা আজ রবিবার (২৮ আগস্ট) কাজে ফিরেছেন।

আজ রবিবার সকালে বিভিন্ন বাগানের বেশ কয়েকজন চা শ্রমিকের সাথে কথা বলেছে সাম্প্রতিক দেশকাল। তাদের প্রায় সবাই মজুরি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, গত ১৮ দিন ধরে আন্দোলন করে তাদের ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেছে। এখন আন্দোলন থেকে সরে আসা ছাড়া অনেকেরই কোনো উপায় নেই। এ কারণেই সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আজ রবিবার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক চা শ্রমিক বলেন, এ দুঃখ দেখার কেউ নাই। প্রধানমন্ত্রী চা-বাগানের মালিকদের সাথে কথা বললেন। আবার এটাও শোনা যাচ্ছে তিনি আমাদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু তিনি শ্রমিকদের সাথে কথা বলার আগেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আমি এই মজুরি মানি না। এমনকি আমাদের বেশিরভাগ সহকর্মী এ মজুরি মানেন না।

চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজারের আহ্বায়ক রাজদেও কৈরী বলেন, ‘চা-শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে আজ মজুরি দাঁড়াল মাত্র ১৭০ টাকা। যা এক লিটার তেলের দামও না। বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে ৬-৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরি, বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র প্রদান বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন। একইসাথে সার্ভিসবুক ও ৯০ দিন কাজ করলেই একজনকে শ্রমিক হিসেবে স্থায়ী করার বিষয়টিও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’

চা-বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১৬৭ টি বাগানে চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের বেশি। এর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক প্রায় এক লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরিতে প্রায় পাঁচজনের ভরণপোষণ চালাতে হয়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বিপ্লব পাশি মান্দ্রাজি বলেন, বর্তমান দ্রব্যমূল্যে ৩০০ টাকা মজুরি দিয়েও সংসার চালানো সম্ভব না। সংসদেও ৫০০ টাকা মজুরির পক্ষে দাবি উঠেছে। অথচ আমাদের মজুরি বলা হলো ১৭০ টাকা। এটা আসলেই খুব কম।

চা বাগান সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে চা-উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। ২০২১ সালে মহামারির মধ্যেও দেশে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা-উৎপাদনে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২৩২ রুপি (২৭৭ টাকা)। তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন।

সরকারি তথ্য মতে, দেশে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ দুই লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। সেখানে নতুন মজুরিতে চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ বার্ষিক আয় হবে ৬১ হাজার ২০০ টাকা।

শমশেরগর চা বাগানের নারী শ্রমিক মনি গোয়ালা ও দেওছড়া চা বাগানের মায়া রবিদাস বলেন, ‘স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, ননদসহ ৮ জনের সংসার আমার। মাসে প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ কেজি চাল লাগে, ডাল তিন কেজি, আড়াই লিটার সয়াবিন তেল, আলু, শাকসবজি, পেঁয়াজ-রসুন-মশলা-লবণ-চিনি, বিদ্যুৎ বিল, সাবান, পূজা, উৎসব, শ্রাদ্ধ ও ইউনিয়ন চাঁদা, ফান্ড, মাছ-মাংস-ডিম, সন্তানদের পড়ালেখা, ও অন্যান্য খরচ আছে। নতুন কাপড় না হয় না-ই কিনলাম। তবু মাসে সর্বনিম্ন খরচ ১০ হাজার টাকা। এই হিসাবেই ন্যূনতম মজুরি ৩০০ টাকা আসে।’

চা শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সিলেটে 'তৃতীয় পক্ষ' নামের নাগরিক সংগঠনের আয়োজন করা নাগরিক সংহতি সমাবেশের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নিরুপায় হয়ে শ্রমিকেরা কাজে ফিরেছেন। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের পর মাত্র ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি সত্যিই হতাশাজনক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //