ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষ ঝিনাইদহের মারুফ

এপর্যন্ত সাপে কাটা ৩০০ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন মারুফ। যদিও তিনি কোন ওঝা বা ডাক্তার নন তারপরেও ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুণ্ডসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় মারুফ এতটাই জনপ্রিয় যে, কাউকে সাপে কাটলেই সাথে সাথে তাকে ফোন করা হয়। গভীর রাত কিংবা দুর্যোগে যেকোনো সময় খবর পাওয়া মাত্র তিনি মোটরসাইকেলে ছুটে যান রোগীর কাছে। পরে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য  যানবাহনে কাছের হাসপাতালে ছোটেন। নেহাত কিছু না পেলে নিজের মোটরসাইকেলে বসিয়েই রোগীদের ‘প্রথম আলো হাসপাতালে’ নেন।  বিষধর সাপে কাটা রোগীকে প্রথম ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া গেলে বাঁচানো যায়। তিনি সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন।

আবদুল্লাহ মারুফের বয়স ৪৫ বছর। ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ড উপজেলার তাহেরহুদা ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ছেলে তিনি। তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। এই দম্পতির রামিসা মালিয়াথ (১৪) ও আবদুল্লাহ আজয়াদ (১১) নামে দুই সন্তান রয়েছে। 

স্বামীর জনকল্যাণমূলক কাজে গর্বিত ইয়াসমিন আক্তার। তিনি বলেন, আমিও সব সময় মারুফকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

জানা গেছে, সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে নেন মারুফ। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি বন্য প্রাণী ভালোবাসেন। কোথাও বন্য প্রাণী আটকা পড়েছে শুনলেই ছুটে গিয়ে মুক্ত করেন তিনি। বিষধর সাপ ধরার খবর পেলেও ছুটে গিয়ে মুক্ত করেন তিনি। সাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তিনি। তিনি সাপের জাত, বিষ প্রয়োগ, অ্যান্টিভেনোমের বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। 

কাউকে সাপে কাটার খবর পেলে মারুফ সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাপড় দিয়ে রোগীর আক্রান্ত স্থানটি বেধে দেন, কোন হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে তা মুঠোফোনে খবর নেন। কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং কোথায় চিকিৎসক প্রস্তুত আছেন তারও খোঁজ নেন তিনি ।

সম্প্রতি হরিণাকুণ্ড উপজেলার ধুলিয়া গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হককে (৪৬) সাপে কাটে। পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে যান এক ওঝার বাড়িতে। সেখানে ঝাড়ফুঁক করা হয়। কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান মারুফ। রোগীর বাড়ি গিয়ে মারুফ শুরুতেই রোগীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন মোজাম্মেল।

স্থানীয় তাহেরহুদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর রাশেদ বলেন, মারুফের কারণে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে সাপে কাটা বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। স্বজনদের বুঝিয়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। বেঁচে যায় একটি প্রাণ। 

তিনি আরো বলেন, পাঁচ বছর ধরে নিরন্তর কাজটি করে চলেছেন এই যুবক। এর মধ্যে অর্ধেক রোগীকে গ্রাম্য ওঝার অপচিকিৎসা থেকে বাঁচিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ মারুফ বলেন, সাপে কাটার কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষ মারা যায় দেশে। এর মূল কারণ গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা। সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে সাধারণত ওঝার কাছে নিয়ে যায় গ্রামের লোকজন। সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগী মারাও যান কখনো কখনো। ঝিনাইদহ জেলার ছয় উপজেলাসহ পাশের চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা উপজেলা, কুষ্টিয়া সদর উপজেলা থেকেও মারুফের কাছে ফোন আসে। এসব এলাকার মধ্যে হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপাতে সাপের উপদ্রব বেশি। কারণ এই দুই উপজেলা থেকেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, গ্রামে বেশ কিছু ধানি জমি আছে মারুফের। রয়েছে মাছের খামার। এসবই দেখাশোনা করেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন মারুফ। এরপর সাংসারিক কারণে কর্মজীবন শুরু করেন। রোগীর কাছে ছোটাছুটিতে যে খরচ হয় সেটা তিনি নিজেই বহন করেন। তবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরের খরচ রোগীর স্বজনেরা দেন। 

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এই অঞ্চলে খৈয়া গোখরা ও পদ্ম গোখরা, কালাস, শঙ্খিনী ও চন্দ্রবুড়া সাপে কাটার ঘটনা বেশি ঘটে। এ এলাকাগুলোতে বিষধর সাপ রয়েছে। তবে সব সময় সাপ মানুষকে কামড় দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে না।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রাজীব চক্রবর্তী জানান, আবদুল্লাহ মারুফ সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।  তিনি মানুষ হিসেবেও বেশ পরোপকারী। মারুফের এই উদ্যোগের ফলে সদরসহ ঝিনাইদহের আশপাশের উপজেলার হাসপাতালগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।

জেলা সিভিল সার্জন শুভ্রা রানী দেবনাথ জানান, ঝিনাইদহের সব কটি হাসপাতালে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রয়েছে। রোগী এলেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। 

তিনি আরো জানান, আবদুল্লাহ মারুফ অবশ্যই সমাজে ভালো কাজ করছেন। তার কারণে সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসা বেড়েছে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, সাপে কাটলে ওঝা নয়, খুব দ্রুত পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে যান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //