১৫০ বছর পর সংরক্ষিত হলো ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মা-বাবার কবর

আজ ৬ সেপ্টেম্বর, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। শৈশবে নিজ এলাকায় আলম নামে পরিচিত ক্ষণজন্মা এই সঙ্গীত শিল্পী গ্রাম বাংলার জারি, সারি গানের টানে মুগ্ধ হয়ে কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দেন যাত্রা দলে। 

এক সময়ের অজপাড়া গ্রামের সেই আলমই সেতার, সানাই এবং রাগ সঙ্গীতের বিখ্যাত মাইহার ঘরনার গুরু হিসেবে সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি পান। তার পৈত্রিক ভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলাউদ্দিন খাঁর হাতে গড়া মসজিদ সংস্কার ও তার বাবা মায়ের কবর সংস্কার করা হলেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিশ্ব বরেণ্য এই সুর সাধকের পৈত্রিক সম্পদ এখন অবৈধ দখলদারদের কবলে। 

স্থানীয়দের দাবি এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদসহ তার স্মৃতি রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হউক। তার মৃত্যুবার্ষিকী প্রতিবারই উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হলেও এবারই প্রথম আলাউদ্দিনের নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার পৈত্রিক ভিটাসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাহত হয়ে এসব সম্পদ উদ্ধার করে আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। 

এছাড়া আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে জেলা পর্যায়ে একটি কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণে পরিকল্পনাটি দীর্ঘ দিনেও বাস্তবায়ন হয়নি। তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য দ্রুত এখানে একটি কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণসহ সরকারীভাবে তার জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করার দাবি স্থানীয়দের। 


১৮৬২  সালের ৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। কিশোর বয়সে তিনি কলকাতার প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের শিষ্যত্বে ৭বছর সরগম সাধন করে যন্ত্রসংগীত সাধনায় নিযুক্ত হন। মূলত এরপর থেকেই তিনি ভারতে বসবাস শুরু করেন। 

তবে তার পিতা-মাতা বাংলাদেশেই থেকে যান। প্রায় দেড়শত বছর আগে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর পিতা-মাতা মৃত্যু বরণ করেন। তাদের শিবপুরে নিজ বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। বিগত দেড়শত বছর যাবত অরক্ষিত ও অবহেলায় ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খার পিতা-মাতার কবর। সেখানে কুকুর ঘুমানোর ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। অবশেষে দেড়শত বছর পর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলাউদ্দিন খাঁর পিতা-মাতার কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে। আজ ৬ সেপ্টেম্বর আলাউদ্দিন খাঁর ৫০তম মৃত্যু বার্ষিকীর আগে তার মা-বাবার কবর সংস্কার শেষ করা হয়েছে৷

ইতিহাসে বিভিন্ন গ্রন্থ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাঙালির এমন এক সুরসাধক যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রচার ও সমাদৃত করেন। তার সংগীতগুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসংগীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। তিনি সংগীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যোগ্য শিষ্য তৈরি তার এক বিশাল কীর্তি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তালিমের গুণে তার পুত্র সরোদশিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং তার জামাতা সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশ্বখ্যাত হয়েছেন এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ, ও ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭২সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারেরই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনাবসান ঘটে। সেখানে তার কবর রয়েছে। তবে শিবপুরে এখনো রয়েছে তার মা-বাবার কবর। কবরটি অযত্ন ও অবহেলায় পড়েছিল। তাদের কবরের সাথে রয়েছে আলাউদ্দিন খাঁর এক বোনের কবরও। তাদের মৃত্যুর প্রায় দেড়শত বছর পর কবরটি সংস্কার করে দৃষ্টি নন্দনভাবে গড়ে তুলা হয়েছে। তার নামে গড়ে উঠেছে শিবপুর ওস্তাদ আলাউদ্দি খাঁ কলেজ। সেই কলেজে তার ইতিহাস সম্বলিত মোড়াল স্থাপিত করা হয়েছে। এছাড়াও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নিজ অর্থ একটি পুকুর খনন করে এক পাড়ে একটি মসজিদ তৈরি করে গিয়েছিলেন। মসজিদটিও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে।

সেই মসজিদটি তত্ত্বাবধান করেন আলাউদ্দিন খাঁর বংশের নাতি খুরশেদ আলম খাঁ বলেন, আমার দাদার মা-বাবার কবর প্রায় দেড়শত বছর অরক্ষিত-অবহেলায় ছিল। সংস্কার করার পর কবরটি খুব সুন্দর লাগবে। মসজিদটি আমি দেখা শোনা করি, এটিও সংস্কার করা হয়েছে৷

স্থানীয় অনেকের দাবি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর অনেক সম্পদ বেদখল হয়ে পড়েছে। এগুলো উচ্ছেদ করে কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি জানান।

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সভাপতি রানা শামীম রতন বলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মারা যাওয়ার পর এই স্থানটির করুন পরিণতি ছিল। ইউএনও একরামুল সিদ্দিকীর একান্ত প্রচেষ্টায় ম্যুরাল তৈরি ও কবরটি সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। আমার দাবি এখানে তার নামে স্মৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তোলা। তার যাবতীয় জিনিস ভারতে সংরক্ষিত আছে। আমরা চাই সেই সব জিনিস ফিরিয়ে এনে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।

নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একরামুল সিদ্দিকী বলেন, আমি যোগদানের পর শিবপুরে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি তার পিতা-মাতার কবর পুকুরে হেলে পড়ে আছে। আর কুকুর ঘুমিয়ে আছে। তেমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এরপর আমি ম্যুরাল তৈরি ও কবরস্থানটি সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের আরো অনেক পরিকল্পনা আছে। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //