দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎবিহীন বরিশাল হাসপাতাল

যেন ভুতুড়ে একটা পরিবেশ! সেখানে শুয়ে আছেন অসংখ্য মানুষ। পাশে বসে আছেন স্বজনরা। নিভো নিভো আলোতে গায়ে ব্যান্ডেজ জড়ানো মানুষগুলোকে হঠাৎ করে দেখলে ভয়ে আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। মাঝে মাঝে আবার একজন চিৎকার দিয়ে উঠছে। হাতে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সেই মানুষগুলোর কাছে ছুটছেন চিকিৎসক এবং সেবিকারা।

গত দুই সপ্তাহ ধরে এমন চিত্র বিরাজমান বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালের বি-ব্লকের নিচ তলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তাই ১ম তলায় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী কর্তৃক পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, বঙ্গবন্ধু ক্লাব ও যুব রেড ক্রিসেন্ট এবং মানসিক ওয়ার্ডের সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ওই ব্লকের ২য় তলার গুরুত্বপূর্ণ রেডিওলোজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গত দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ রয়েছে সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, আল্টাসোনগ্রাম পরীক্ষা নিরীক্ষা। একই কারণে বি-ব্লকের ৩য় তলায় মেডিসিন-১ নং ইউনিট, ৪র্থ তলায় মহিলা মেডিসিন ১, ২, ৩ ও ৪ নং ইউনিটের চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।


এরই মধ্যে গত বুধবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে হাসপাতালের বি-ব্লকের ন্যায়ে জি-ব্লকের ১ম তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। সেই থেকে ওই ব্লকের গুরুত্বপূর্ণ ১ম তলায় মেডিসিন আউটডোর, টিকা দান কেন্দ্র, গাইনি বহির্বিভাগ, জেনারেল স্টোরের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জি-ব্লকের ২য় তলায় গাইনি পেয়িং বেড ও ৩য় থেকে ৫ তলায় সার্জারি ১, ২, ৩ ও ৪ নং ইউনিট এবং ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

সরেজমিনে হাসপাতালের জি-ব্লকের ৩য় তলায় সার্জারি-২ ইউনিট ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ না থাকায় রোগীরা রয়েছেন অন্ধকারে। ইউনিটটিতে শুক্রবার ছিলো রোগী ভর্তির দিন। কোন শয্যা খালি নেই, নতুন রোগী ভর্তি হলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ওয়ার্ড এবং বারান্দার মেঝেতে। কিন্তু সেখানেও অন্ধকার। রোগী ও স্বজনরা মোবাইলের টর্চ দিয়ে আলোর দেখা পাচ্ছে। এমনকি নার্স ও চিকিৎসকরা মোবাইলের টর্চ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন।

সার্জারি-২ ইউনিটের ইনচার্জ নাসিং কর্মকর্তা রিতা বাড়ৈ বলেন, সকালে আমরা যারা ডিউটিতে এসেছি তাদের মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। সারাক্ষণ মোবাইলের টর্চ অন করে কাজ করতে হচ্ছে। গত বুধবার থেকে এ অবস্থা বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ না থাকায় রোগীদের পাশাপাশি আমরাও নিরাপত্তাহিনতায় ভুগছি। অন্ধকারে চুরির ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


সার্জারি-২ ইউনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. সৈকত বলেন, বুধবার আমাদের ইউনিটে রোগী ভর্তির দিন ছিল। সকাল থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক দুর্ঘটনা জনিত কারণে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাদের জরুরি ভিত্তিতে অপারেশনের প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের অপারেশন করা খুবই দুরহ। তার পরেও মোবাইলের টর্চ বা মোমবাতির আলোতে অপারেশন করে যাচ্ছি। এভাবে একটি হাসপাতাল চলতে পারে না।

পটুয়াখালী থেকে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের পঞ্চম তলায় সার্জারি বিভাগে ভর্তি থাকা আয়নাল নামের একজন রোগীর স্বজন আব্দুর রহমান বলেন, দেখলাম হাসপাতালের সামনে কোটি টাকা ব্যয়ে গেট নির্মাণ করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোটি টাকা খবর করে বাইরের চেহারা সুন্দর করলেও ভেতরে চিকিৎসা সেবার করুন অবস্থা।

তিনি বলেন, তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই সার্জারি ইউনিটে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এতে রোগী এবং আমরা স্বজনরা ভোগান্তি পোহাচ্ছি। সন্ধ্যার পরে রাতভর অন্ধকারে কতটা কষ্টে কাটে সেটা বলে বোঝাবার মত নয়। খাওয়া-দাওয়া, বাথরুম সবই অন্ধকারে মোবাইল অথবা টর্চ লাইট জ্বালিয়েই সাড়তে হচ্ছে। আবার টয়লেটের অবস্থাও করুণ। আমি মনে করে গেটের চেয়ে রোগীর সেবার মান বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়াটা জরুরি।


এদিকে, হাসপাতালের চারটি ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, বিদ্যুৎবিহীন রাতে ওয়ার্ডগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। রোগীদের ওষুধপত্র, মোবাইল ফোন এবং টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেবাচিম হাসপাতালে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কাজ কারে থাকে গণপূর্ত ইএম-উপবিভাগ। এ বিভাগে দায়িত্বরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. ফিরোজ আলম বলেন, গত ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে অস্বাভাবিকভাবে পানি প্রবেশ করে নিচ তলার প্রায় দুই ফুট প্লাবিত হয়।

এ কারণে আন্ডার গ্রাউন্ডের (মাটির নিচে) বিদ্যুৎ সংযোগের তার বিকল হয়ে যায়। একারণে ওই সময় (২৫ অক্টোবর) দুটি ফেইজ পুরে যায়। ফলে হাসপাতালের বি-ব্লকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। স্থানীয়ভাবে মেরামতে পর ওই ফেইজ ঠিক হলেও তা স্থায়ী হয়নি। তার সাথে গত ৯ নভেম্বর বিকালে জি-ব্লকের ফেইজ দুটি বিকল হয়। স্থানীয়ভাবে জোড়া তালি দিয়ে এই চারটি ফিউজ মেরামত করা সম্ভব হয়নি।


তিনি বলেন, ৫০ বছরের বেশি এই হাসপাতালের বয়স। প্রতিষ্ঠাকালে এই হাসপাতালের সকল বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচ থেকে নেয়া হয়েছিলো। বয়সের কারণে লাইনের তারগুলো বিকল হয়ে পড়ছে। এখন আর মাটির নিচ থেকে বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হবে না। ভবনের ভিতরেই সরাসরি বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হবে। কিন্তু এ কাজে অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন। যে দুটি ব্লকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই সেগুলো মেরামত করতে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। আশাকরি চলতি সপ্তাহে মেরামতের কাজ শুরু হবে। তবে আগামী সপ্তাহ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালের জি এবং বি-ব্লকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এতে ওই দুই ব্লকে মেডিসিন, সার্জারি, ডেন্টাল, মানসিক ও রেডিওলোজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে ওই ওয়ার্ডগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করতে গণপূর্তকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের এ কাজটি করতে সময়ের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //