আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর এখন গলার কাঁটা

এক বছর আগে বউয়ের নামে একটা ঘর পাইছি, এহনও দলিল পাই নাই। এমন জায়গায় ঘর দিছে যাতায়াতের রাস্তা নাই, আশেপাশে হাটবাজার নাই, কোনোকিছু কইরা খাওনেরও উপায় নাই।

নামেই সরকারি ঘর, এক বছর না যেতেই ফাটল ধরছে, নিয়াও বিপদে পড়ছি।’ কথাগুলো বলছিলেন জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের দুর্গম ঘুইঞ্চার চর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হানিফ দেওয়ান। শুধু তিনিই নন; এমনই ক্ষোভ সুবিধাভোগী অনেকের। যেন ঘর ছাড়লেই বাঁচেন তারা।

প্রভাবশালীচক্রের পছন্দমতো জায়গা নির্বাচন ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে জলে যেতে বসেছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ফলে প্রকল্পটি এখন প্রশাসনের গলার কাঁটায় পরিণত।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প (ফেস ২)-এর অধীনে সরিষাবাড়ী উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ম পর্যায়ে ২৯৫টি ঘর বরাদ্দ হয়। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। ২য় পর্যায়ে প্রতিটি এক লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ২৫টি ঘর।

সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিটি দুই লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় আরও তিনটি ঘর। সর্বমোট ৩২৩টি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন ও উদ্বোধনের পর উপকারভোগীদের হাতে দলিল হস্তান্তর দেখানো হলেও বাস্তবে মিলেছে এর উল্টো চিত্র। যমুনা নদীঘেঁষা দুর্গম এলাকা ঘুইঞ্চার চরে নির্মিত ১৪৬টি ঘর নির্মাণে দুই কোটি ৪৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকার পুরোটাই জলে গেছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, দুটি নদী পার হয়ে এবং প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে হয় ঘুইঞ্চার চর আশ্রয়ণ প্রকল্পে। যাতায়াতের রাস্তা বলতে ক্ষেতের সরু আইল। আশপাশে নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, এমনকি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকায় গা ছমছমে পরিবেশ।

১৪৬টি ঘরের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬টি ঘরের উপকারভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বাকি ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে। বেশ কয়েকটি ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। টিনের চালে স্ক্রুর বদলে তারকাঁটা ব্যবহার করায় বৃষ্টির পানি পড়ে চুইয়ে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার লেখা সংবলিত সাইনবোর্ডগুলো টানানো হয়নি কোনো ঘরেই, একটি ঘরের মেঝেতে সেগুলো অযত্নে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

একটি ঘর ছয় মাস আগে ঝড়ে ভেঙে পাশের খাদে পড়ে থাকলেও সেটি উদ্ধার করতে এগিয়ে যায়নি কর্তৃপক্ষ। সুবিধাভোগীদের মতে, আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ফাঁকা পড়ে থাকায় শুধু স্থানীয় কৃষকদের ক্লান্তি দূর করতে বিশ্রামের স্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। অধিকাংশ ঘরের বারান্দায় চরাঞ্চলের মানুষ দিনে গরু-ছাগল বেঁধে রাখেন। আগাছায় ভরে গেছে অনেক ঘরের সামনে।

সুবিধাভোগীদের মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মফিজ উদ্দিন জানান, তিনি ঘর পেয়ে তারাকান্দি থেকে এখানে এসেছেন। অথচ এখানে ছাগল-গরু পর্যন্ত চরানোর পরিবেশ নেই। যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় এলাকায় কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। কর্মহীন থাকতে হয়, বিধায় কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

প্রতিবন্ধী আনোয়ার হোসেন জানান, সরকার তাকে ঘর দিলেও, কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেননি। মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে হয়। কিন্তু এমন জায়গায় তাকে ঘর দিয়েছে যে, আশপাশে ভিক্ষা করারও উপায় নেই।

গৃহবধূ রেহানা বেগম জানান, লোকজন ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ায় রাতে ভুতুড়ে পরিবেশ হয়, জিনিসপত্র চোরে নিয়ে যায়। ১৫টি নলকূপ দিয়েছিল, একটি অবশিষ্ট আছে, বাকিগুলো চুরি হয়ে গেছে। যে নলকূপটি আছে, তার পানিতে আয়রন এবং দুর্গন্ধযুক্ত। পানি খাওয়া ও অন্যান্য ব্যবহারের অনুপযোগী বলে দেড়-দুই মাইল দূর থেকে সবাইকে পানি এনে পানাহার করতে হয়।

এ ব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে উপজেলার মোট ৩৭টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঘুইঞ্চার চরে ১৫টি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি নলকূপের খরচ পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা করে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি নলকূপের গভীরতা ৬১ মিটার, ফলে পানিতে আয়রন থাকলেও কিছু করণীয় নেই। এ ছাড়া মালিকানা হস্তান্তর করার পর চুরি প্রতিরোধে উপকারভোগীদেরই সজাগ থাকতে হবে বলেও তিনি জানান।

এদিকে সরিষাবাড়ী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নুরুল হুদা বলেন, অনেক ঘরে লোক না থাকায় বিল বকেয়া পড়ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের এমন করুণ দশা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপমা ফারিসা বলেন, আমি যোগদানের আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো করা হয়েছে। শুরুতে ঘর নেওয়ার জন্য অনেকের আগ্রহ ছিল বলে শুনেছি। ঘুইঞ্চার চরের ঘরগুলোতে বসবাসের উপযোগী করতে প্রশাসন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাতায়াতের রাস্তা করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //