শীতকালেই কেন খেজুর গাছে মিষ্টি রস

শীতকাল আসলেই প্রকৃতিতে হরেক রকমের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এই শীতেই পাওয়া যায় প্রকৃতির এক অন্যান্য অনুভূতির স্বাদ। নতুন ধানের আমেজ, নতুন নতুন পিঠা তৈরি, শাক-সবজিসহ প্রকৃতি বিলিয়ে দেয় মানুষকে তার ভেতরের এক অন্যতম অনুভূতি। শীতের এতকিছুর মধ্যে অন্যতম আরেকটি অনুষঙ্গ হলো খেজুর গাছ থেকে আহরণ করা খেজুর গাছের রস। 

তবে এই রস কেবল শীতকালেই পাওয়া যায়। অন্য কোনো ঋতুতে খেজুর গাছে আসে না এই মিষ্টি রস। কেনই বা আসে না?  শীতেই কেন আসে? এমন প্রশ্ন হাজারো মনে ঘুরে বেড়ায় বারবার। চলুন তবে জেনে নেই কেন এমন ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য খেজুর গাছ প্রকাশ করে, ঋতুর সাথে এই রসের সম্পর্কটাই বা কী!

সব গাছই সাধারণত মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে। এই পানি পাতায় পৌঁছে গেলে পাতায় সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে খাবার তৈরি হয় তা হলো মূলত গ্লুকোজ। গ্লুকোজ পরে ফাইটোহরমোনের (উদ্ভিদ হরমোন) প্রভাবে সুক্রোজে রূপান্তরিত হয়। এই গ্লুকোজ বা সুক্রোজ গাছ তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য খরচ করে থাকে এবং অতিরিক্ত গ্লুকোজ বা সুক্রোজকে স্টার্চ (অদ্রবণীয় জটিল শর্করা) হিসেবে জমা করে রাখে। 

চিনি মিষ্টি হলেও স্টার্চ মিষ্টি নয়। বর্ষাকালে মাটিতে প্রচুর পানি থাকে বলে মূলের মাধ্যমে প্রচুর পানি শোষণ করে এবং পাতায় প্রচুর খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে মাটিতে পানি কম থাকে বলে পানির অভাবে পাতায় কম খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য খেজুর গাছ অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করে রাখে। তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে মূল থেকে পানির শোষণ কম হতে থাকে। তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে খেজুর গাছের কোষে এক ধরনের এনজাইম ক্ষরণ হতে শুরু করে। আর এই এনজাইম খেজুর গাছে অতিরিক্ত জমে থাকা স্টার্চ ভাঙতে শুরু করে এবং তা আবার সুক্রোজ বা চিনিতে পরিণত হয়। মূল মাধ্যমে শোষিত পানির সাথে এই সুক্রোজ মিশে গিয়ে একধরনের শরবত মত দ্রবণ তৈরি হয় যাকে আমারা খেজুরের রস বলে থাকি। যেহেতু মূল থেকে উঠা পানি উপরের দিকে ধাবিত হয়, তাই রস উপরের অংশে থাকা কোনো ক্ষত দিয়ে বের হয়।

শীতকালে গাছের প্রস্বেদন কম হওয়ায় গাছ থেকে খুব কম পরিমাণ পানি বাইরে বাষ্পাকারে বের হয়। প্রস্বেদনের মাধ্যমে পানি বাইরে বের না হলেও ক্ষত দিয়ে সুক্রোজযুক্ত পানি বের হয়ে যায়। যত বেশি বের হবে তত ব্যাপন চাপ ঘাটতি সৃষ্টি হয়, এই চাপ ঘাটতির কারণে একটি শক্তির উদ্ভব হয় যা মূল দিয়ে পানি চুষতে সাহায্য করে। চোষণ শক্তির প্রভাবে মাটি থেকে পানি শোষিত হয় এবং প্রস্বেদন কমে গিয়ে ক্ষতের মাধ্যমে শীতকালজুড়ে সুক্রোজযুক্ত পানির দ্রবণ (খেজুর রস) বের হতে থাকে।

জেনে রাখা ভালো, সাধারণত একটি খেজুর গাছের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর না হলে রস উৎপাদন করতে পারে না। একটি পূর্ণ বয়স্ক খেজুর গাছ শীত মৌসুমে ১৫০-১৬০ লিটার রস উৎপাদন করতে পারে। খেজুর গাছের কাণ্ড নরম, রসালো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কাণ্ড শক্ত হতে থাকে। শুষ্ক মরুভূমিতে এরা ভালো জন্মে। তবে বিশ্বের নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলেও এদের ব্যাপক বিস্তৃতি লক্ষ করা যায়।

খেজুর গাছকে ‘ক্ষত বৃক্ষ’ বা Wounded Tree ও বলা হয়ে থাকে। কারণ কত শত ক্ষত সহ্য করে খেজুর গাছ আমাদের সুস্বাদু রস দিয়ে থাকে। খেজুর গাছ এক ধরনের তাল জাতীয় গাছ। ডাব, তাল, সুপারি ইত্যাদি গাছের শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো Phoenix dectylifera। খেজুর গাছের বৈজ্ঞানিক নামের দ্বিতীয় অংশ dactylifera দুটি ভাষা থেকে এসেছে যার একটি অংশ গ্রীক ভাষা dactulos থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ খেজুর। অপর অংশ ল্যাটিন ভাষা fero থেকে এসেছে যার অর্থ বহন করি। তাহলে dactylifera শব্দের পূর্ণ অর্থ হয় ‘খেজুর বহনকারী।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //