দেড় হাজারের বেশি মামলা

মাদকের ভয়াল থাবা চাঁপাইনবাবগঞ্জে

দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাথে সীমান্ত রয়েছে ভারতের। এই জেলা দিয়ে অবাধে প্রবেশ করছে ইয়াবা, গাঁজা, আফিমসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। গত দুই বছরে শুধু মাদকের মামলা হয়েছে দেড় হাজারের বেশি। মাদকে সংশ্লিষ্টতার দায়ে ১৬৪৫টি মামলায় ১৭৩৭ জন আসামি হয়েছে। এ জেলায় রুজু হওয়া মামলা অধিকাংশই মাদকের।

এদিকে অর্থলোভের কারণে মামলা শাস্তির পরও ব্যবসা ছাড়ছে না মাদককারবারিরা। 

অন্যদিকে এ অঞ্চলে হাত বাড়ালেই মাদক মেলে। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবনে। এতে ধ্বংস হচ্ছে পরিবার ও সমাজ। বর্তমানে মাদক চোরাচালান ঠেকানো ও বিস্তার রোধই পশ্চিমাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাদক রোধে সীমান্তের অনেক স্থানে বর্ডার অবজারভেশন চেকপোস্ট রয়েছে বিজিবির। তবে পর্যাপ্ত না থাকায় এ সুযোগে মাদককারবারি ও পাচারকারীরা জেলার বিভিন্ন পথকে তাদের মাদক বহনের রাস্তা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এই মাদকগুলো দেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে। যা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। প্রতিদিন এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সীমান্তপথে ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক ঢোকার পাশাপাশি জেলায় জেলায় এর বিস্তার ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত তৎপরতার মধ্যেও মাদকের ভয়াল ছোবল কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৩৩১৩টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে তিন কেজি হিরোইন, ২৩৩৫টি ফেনসিডিল, ৯৯২৪ পিস ইয়াবা, ২৬০ কেজি গাঁজা, ৮ বোতল মদ, ১২১২ ব্রুপেনরফিন ইনজেকশন, ৪৫৫টি ডায়াজিপাম ইনজেকশন, ২৪টি মোটরসাইকেল, ১০০৯ লিটার চোলাইমদ, ৫৭লিটার তাঁড়ি, ৭০০ লিটার ওয়াশ, নগদ সাড়ে চার লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এতে ১৬৪৫টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৭৩৭ জনকে। অধিকাংশ আসামিকে আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর আরো বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগার থেকে বেরিয়েই আবার মাদককারবারিতে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। 

জানা গেছে, এ জেলাতে ৫টি থানা রয়েছে। থানায় নানা অপরাধে প্রতিদিন যে সংখ্যক মামলা রুজু হয়, তার ৯০ ভাগই মাদকসংক্রান্ত অপরাধের মামলা। শুধু তাই নয়, কারাগারে যত বন্দী রয়েছে অধিকাংশই মাদকের। আদালতগুলোতেও মাদকের মামলায় জট লেগে রয়েছে। ফলে মামলার চূড়ান্ত রায়ও দেরিতে হয়। তাছাড়া মামলায় আটক হলে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বেরিয়ে এসে মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে। একেকজন মাদককারবারিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। 

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশই মাদকাসক্ত খারাপ সঙ্গের কারণে মাদকে জড়িয়ে পড়ে। পরে মাদকের অর্থ যোগানের জন্য বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়। তবে ইয়াবায় আসক্ত হলে অপরাধীরা ক্রমে সহিংস হয়ে উঠে। টাকার জন্য মানুষকে হত্যার মত জঘন্য কাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। সুতরাং মাদকনির্মূলে জোর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে জাতি মেধাশূন্য হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সীমান্তপথে ভারত থেকে আসা মাদকের একটা বড় অংশই চালান হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাটবাজার ও লোকালয়ে গড়ে উঠেছে মাদক কেনা-বেচার আখড়া। এর ফলে হাতে পাওয়া সহজলভ্য হয়েছে। মাদক বিস্তারের সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতারও অভিযোগ আছে। 

তাদের ভাষ্যমতে, এ অঞ্চলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ, র‌্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ভারতের সাথে স্থলের পাশাপাশি বিশাল জলসীমান্তও রয়েছে। এসব সীমান্ত পথেই অঞ্চলের বিভিন্ন মোকামে মাদকের চালান ঢোকে ভারত থেকে। বিজিবির নিয়মিত টহল, নজরদারি ও নিবিড় তৎপরতার ভেতরেও সীমান্তের কঠোর বেষ্টনী পেরিয়ে মাদকের চালান আসছে নানাভাবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ সুরুজ মিয়া বলেন, শুধু সীমান্তবাহিনী অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই মাদকের এই আগ্রাসন ঠেকানো কঠিন। সীমান্ত এলাকায় বিজিবির আউটপোস্টগুলোর (ফাঁড়ি) দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের বেশি। বিজিবির হাতে আধুনিক যানবাহনও কম। টহল পরিচালনার পথও কিছুটা দুর্গম। একটি টহল দল একদিকে গেলে বিপরীত দিক দিয়ে মাদক ঢুকে পড়ে। তিনি আরো বলেন, মাদক চোরাচালান পুরোপুরি ঠেকাতে স্থানীয় বাসিন্দাসহ সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন। সমাজের অনেক প্রভাবশালীই মাদক পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে তাদের আইনের আওতায় নেওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে শুধু বাহকরাই ধরা পড়েন। মূল মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আনিছুর রহমান খান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, মাদকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য পাচার, ব্যবসা ও সেবনের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু যারা আটক হচ্ছে তারা অধিকাংশই বহনকারী। মালিকরা আটক হচ্ছে না। তাদের নামে মামলা হলে তারা উচ্চ আদালতে আশ্রয় নেয়। এ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছে মাদকদ্রব্য ইয়াবা ও ফেনসিডিল। আকারে ছোট হওয়ায় বহন করা সহজ তাই বেশি মাদককারবারীরা ইয়াবা ও ফেনসিডিল পাচার করছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //