বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে রমরমা বাণিজ্য!

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা মাত্র ৬৩৩ জন। সেখানে বর্তমানে বন্দি আছেন এক হাজারের অধিক। ফলে কারাগারের অভ্যন্তরে মানবেতর দিন কাটছে কয়েদি এবং হাজতিদের। বন্দির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে কমতে শুরু করেছে কয়েদি এবং হাজতিদের সুযোগ সুবিধাও। তার ওপর জায়গা স্বল্পতার অজুহাতে কারাগারের ভেতরে চলছে রমরমা বাণিজ্য। কারারক্ষীদের টাকা দিলে মেলে ঘুমানোর জায়গা। আর না দিলে না ঘুমিয়েই রাত কাটাতে হয় বন্দিদের। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আসামিদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ উঠে এসেছে।

এদিকে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কারা অভ্যন্তরে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। তবে ভেতরে অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয়। কারা অভ্যন্তরে চাপ বাড়লেও সুযোগ সুবিধা বা ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি নেই। 

বন্দিরা জেল কোড অনুযায়ী সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. নুর-ই-আলম সিদ্দিকী।

উল্লেখ্য, ১৮২৯ সালে বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র সদর রোড, লাইন রোড, বাজার রোড এলাকা মিলিয়ে প্রায় ২২ একর জমিতে স্থাপিত হয় বরিশাল জেলা কারাগার। এরমধ্যে ৯ দশমিক ছয় একর কারা অভ্যন্তরে এবং বাইরে রয়েছে প্রায় ১২ একর। ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ এই নীতিবাক্য নিয়ে স্থাপিত জেলা কারাগারটি ১৯৯৭ সালের ৩ মার্চ এটিকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে উন্নীত করে সরকার।

জানা গেছে, ৬৩৩ জন বন্দি ধারণক্ষমতার এই বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ৫৮ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল, পাঁচটি বন্দি ভবন, ১২টি সেল এবং একটি লাইব্রেরি রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে এক হাজার ৯ জন বন্দী রয়েছেন। যাদের মধ্যে নারী বন্দী ৩৩ জন এবং বাকি ৯৭৬ জন আছেন পুরুষ বন্দী।

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী জানান, ৬৩৩ জন বন্দি ধারণক্ষমতার কেন্দ্রীয় কারাগারে নারী বন্দির ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৩০ জন। এছাড়া পুরুষ বন্দির ধারণক্ষমতা ৬০৩ জন। তার অনুকূলে বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ৩৩৬ জন কয়েদি এবং ৬৭৩ জন হাজতি রয়েছে। বন্দিদের ব্যবস্থাপনার জন্য কারাগারে লোকবল রয়েছে প্রায় আড়াইশো জন। তবে ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারাগারের অভ্যন্তরে যেসব ভবন রয়েছে সেগুলোতে ধারণক্ষমতার থেকে বেশি বন্দি রাখা সম্ভব। এতে কোনো সমস্যা হয় না।

তবে রাজনৈতিক মামলায় বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া একজন যুবদল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজনীতি করায় গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেখানে থেকে দেখেছি কতটা কষ্ট আর মানবেতর জীবন কাটছে বন্দিদের। চিকিৎসা, ঘুম, খাবার সব কিছুতেই কষ্টে থাকতে হয় তাদের। এমনকি শৌচাগারের ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। রাতে এবং দিনে ব্যবহারের জন্য রয়েছে ১২৪টির মত টয়লেট। যার মধ্যে রাতে ৪৭টি টয়লেট ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে। তবে টাকা দিলে মেলে সুব্যবস্থা।

মারামারি মামলায় সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া অপর এক বন্দি বলেন, ‘কারাগারের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ওয়ার্ড রয়েছে। যেখানে হাজতিদের থাকতে হয়। এর মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ ১ থেকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৭০ জন বন্দির কক্ষে থাকতে হচ্ছে একশো জনের বেশি। কীর্তনখোলা ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৯০ জন বন্দির কক্ষে ঘুমাতে হয় প্রায় দেড়শো বন্দিকে। ধানসিঁড়ি ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০ জনের জায়গায় থাকতে হচ্ছে ৭০ জনের ওপরে। রূপসী, আমদানি, কিশোর, ডিভিশন এবং মহিলা ওয়ার্ডগুলোরও একই অবস্থা বলে জানান তিনি।

কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া হাজতিরা অভিযোগ করে বলেন, ‘বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে “রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ” এই নীতিবাক্য লেখা থাকলেও বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। কেননা কারাগারের অভ্যন্তরে টাকা দিলে নানা রকম সুবিধা মেলে। আর যার টাকা নেই তার কষ্ট ও দুর্ভোগের শেষ নেই। থাকার জন্য জায়গা পেতে টাকা দিতে হচ্ছে কারারক্ষীদের। খাবার পেতে টাকা দিতে হচ্ছে। কারাগারের ক্যান্টিনে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় তা বাইরের অনিময়কেও হার মানায়। তাছাড়া স্বজনরা কারাগারে খাবার ও টাকা দিয়ে আসলে তাও সঠিক পরিমাণে হাজতিদের বুঝিয়ে দেয় না কারারক্ষীরা। কারাগারের মধ্যে সব থেকে বেশি চাহিদা হাসপাতালের। কিন্তু সেখানে যেতে কোন কোন ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হয়। তবে টাকা হলে সেটার প্রয়োজন হয় না।

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের নানান সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়ের সাথে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কারাগারে জায়গা স্বল্পতা আছে। তবে বর্তমানে যে সংখ্যক বন্দি আছে তাতে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। একটি বাড়তি চাপ থাকলেও আমরা ম্যানেজ করে নিচ্ছি। কারণ প্রতি সপ্তাহেই এক থেকে দেড়শো বন্দি জামিনে মুক্তি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে দৈনিক কতজন নতুন বন্দি আসবে সেটা নিশ্চিত করা বলা যাচ্ছে না। কোন দিন ৫ থেকে ৬ জনও আসেন, আবার কখনো ৬০-৭০ জনও আসতে পারে। তবে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা তুলনামূলক কম। দেশব্যাপী যখন মৎস্য অভিযান চলে তখন বন্দির সংখ্যা বেড়ে যায়। গেলো মৎস্য সম্পদ রক্ষার অভিযানের সময় বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে সর্বোচ্চ এক হাজার ৯ শো’র বেশি বন্দী ছিল।

তিনি আরো বলেন, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে যেসব ভবন রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। ভবনের কক্ষগুলো বড় বড়। সেখানে বন্দিদের থাকতে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। জেলকোড অনুযায়ী বন্দিদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //