জুমচাষে পাহাড়ের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাবে মৌসুমের শুরুতে খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে জুমের ফসল উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। যে কারণে আবাদি জুমভূমির পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদন কমে আসছে। এই তিন জেলায় আউশ ফলন হিসেবে হাইব্রিড, উফশী ও জুমে ধান আবাদ হয়ে থাকে। 

তবে হাইব্রিড ও উফশীজাত মূলত সমতল জমিতে আবাদ হলেও জুম আবাদ হয়ে থাকে ঢালু পাহাড়ে। তবে গোটা আউশ মৌসুমের আবাদি শস্যের সিংহভাগ উৎপাদনই আসে প্রধানত জুমের ধান থেকে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন পার্বত্য জেলায় তুলনামূলকভাবে জুম আবাদের জমি বাড়লেও ফসল উৎপাদন কমেছে।

জুম চাষিরা জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালি কেটে আগুনে পুড়ে তৈরিকৃত জমি বা পাহাড়ে চাষাবাদ করার পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। জুমচাষ এক ধরনের স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জুমের ফলন ঘরে তোলে পরিবারগুলো। তবে দেরিতে আবাদের কারণে অনেকে অক্টোবরেও জুমের ধান তোলেন। জুমে স্থানীয় জাত হিসাবে গেলং, কবরক, পাত্তিকী, সোনালি চিকন, বিন্নি, বাশধান, মেরী ধান, সাদা চড়ুই ধান, কনক চাপা, রেঙ্গই লাগানো হয়। এসব ধানের মূল বৈশিষ্ট্য সুগন্ধি এবং আঠালো। 

তবে জুমে ধানের পাশাপাশি ‘সাথি সফল’ হিসেবে ভুট্টা, শসা, মরিচ, বেগুন, শিম, তিল, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, করলা, পাহাড়ি আলু, সাবারাঙ (একধরনের সুগন্ধিযুক্ত পাতা), কচু, হলুদ লাগানো হয়। অন্যদিকে, জুম ক্ষেতে আগুন দেওয়ায় কারণে পাহাড়ের গাছপালা ও কীটপতঙ্গ পুড়ে যাওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য বিপদাপন্ন হয়ে পড়ায় পরিবেশবাদীদের জুমে চাষ পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যনিরাপত্তা ও বিকল্প খাদ্য জোগানোর সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় এই চাষাবাদ পদ্ধতি এখনো গুরুত্ববহ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চলের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ মৌসুমে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলায় ১৭ হাজার ৭৮০ হেক্টর পাহাড়ে জুম আবাদ হয়েছে, যা থেকে ২৭ হাজার ৯৫৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ মৌসুমে ১৬ হাজার ১৬৮ হেক্টর পাহাড়ে জুম আবাদ হলেও উৎপাদন হয়েছে ২২ হাজার ৭২৫ মেট্রিক টন। সবশেষ ২০২২-২৩ মৌসুমে ১৭ হাজার ৪২২ হেক্টর পাহাড়ে আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২২ হাজার ৫২৪ মেট্রিক টন।

তিন বছরের উৎপাদন ও আবাদের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০-২১ মৌসুম থেকে ২০২১-২২ মৌসুমে আবাদ ও উৎপাদন দুটোই কমেছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে বিগত মৌসুমের চেয়ে ১ হাজার ২৫৪ হেক্টরে আবাদ বাড়লেও উৎপাদন কমেছে আরও ১৯৯ টন। বিগত তিন মৌসুমে আবাদি জুম পাহাড়ের সংখ্যা কমতি-বাড়তি হলেও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী। 

অন্যদিকে জুমসহ তিন জেলার আউশের মোট ফলন উৎপাদনের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় ২৪ হাজার ৪৫৩ হেক্টর সমতল জমি ও পাহাড়ে আউশ আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৫৫ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ মৌসুমে ২২ হাজার ৮০৮ হেক্টরে আবাদের বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ৪৪ হাজার ১০ মেট্রিক টন। সবশেষ চলতি মৌসুমে ২৪ হাজার ৪১৯ হেক্টরে আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪৩ হাজার ২৮১ মেট্রিক টন।

ডিএই-এর হিসাবেই তিন পার্বত্য জেলাতে ক্রমান্বয়ে আউশ মৌসুমে ধান উৎপাদন কমে এসেছে। আউশ মৌসুমে হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধানে উৎপাদন না কমলেও মূলত জুমের ধানে উৎপাদন কমেছে দুই বছরের মাথায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের খাদ্যশস্যের জোগান হয়ে থাকে আউশ ও বোরো ধান থেকে। ঘাটতি নিরাপত্তার বড় জোগান আসে আউশের মৌসুমের জুমের ধান থেকেই। তবে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে জুমের ফলন উৎপাদন নিম্নমুখী।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বান্দরবানের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিগত কয়েক বছরে এপ্রিল-মে মাসে জুম লাগানোর পর অনাবৃষ্টির কারণে জুমের ফলন ভালো হচ্ছে না। চলতি বছরও জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত অন্যান্য বছরের থেকে এক- তৃতীয়াংশ বৃষ্টিপাতও হয়নি। অনাবৃষ্টিতে খরায় জুমের ফলন উৎপাদনে ভাটা পড়ছে। 

ডিএই রাঙামাটি কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ তপন কুমার পাল জানান, পাহাড়ের মানুষের খাদ্যশস্য হিসাবে চালের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে আউশ ও বোরো আবাদ থেকে। তবে আউশ মৌসুমের জুম আবাদ থেকেও উৎপাদনের একটি বড় সহায়তা মেলে। গেল বছরে জুম লাগানোর শুরুতে অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমে আসছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //