বরিশালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, একদিনে আক্রান্ত ৬২

রাজধানী ঢাকার পর এবার বরিশালেও বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু রোগী। মাত্র একদিনেই বরিশাল বিভাগে ৬২ জনের ডেঙ্গু সনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন ২৯ জন।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। এ থেকেই ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর। তাছাড়া একসঙ্গে এতো ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হওয়ার বিষয়টিকে হুমকি হিসেবেই দেখছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

তবে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়লেও এডিস মশা নিধন কার্যক্রমে গতি নেই বরিশালে। দেখা যাচ্ছে না ডেঙ্গু সচেতনতামূলক কার্যক্রম। বরিশালে এডিস মশা আছে কিনা তাও জানা নেই সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য বিভাগের। এমনকি এডিস মশার ওপর সবশেষ সার্ভে কবে হয়েছে তাও জানেন না সংশ্লিষ্টরা। আর এ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন নগরবাসী।

যদিও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি নগরীতে এডিস মশার উপস্থিতি নেই। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা সবাই শহরের বাইরের। তারপরও মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন তারা।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সার্ভে না হলেও আপাতত চিকিৎসাতেই চলছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম। তাছাড়া ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখনো ব্যবস্থা হয়নি পৃথক ডেঙ্গু ওয়ার্ডের। সাধারণ রোগীদের সাথেই রাখা হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাসের শুরু থেকেই এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। তবে জুন থেকে চলতি জুলাই মাস পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে গত ৩ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৪ জুলাই সকাল ৮টা পর্যন্ত। এসময় ২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন এ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে।

তাছাড়া চলতি মাসের ৪ জুলাই পর্যন্ত মোট ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে শেবাচিম হাসপাতালে। এর আগে, জুন মাসে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন ১৪৯ জন রোগী।

এই মাসেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে শেবাচিম হাসপাতালে। তার আগে অর্থাৎ মে মাসে ১৬ জন আক্রান্ত এবং একজনের মৃত্যু, এপ্রিল মাসে ৩ জন, মার্চ মাসে ২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন এবং জানুয়ারি মাসে ১৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছিলেন।

গত সোমবার দুপুরের দিকে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার কানুদাসকাঠি গ্রামের জাহিদুল ইসলাম (২২)।

তার মা শাহনাজ বেগম জানান, তার ছেলে ঈদের পূর্বে একমাস ঢাকায় বাবুর্চির কাজ করেছে। ঈদের একদিন আগেই বাড়িতে আসে। এসে বৃষ্টিতে ভিজে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্না করে। এরপর দিন থেকেই গায়ে জ্বর আসে। পরে সোমবার দুপুরে হাসপাতালে ভর্তি করে পরীক্ষা করে জানা যায় সে ডেঙ্গু আক্রান্ত।

পাশের বেডেই চিকিৎসাধীন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমির হোসেনের ছেলে আরিফ (১৯)। আলাপকালে তার স্বজনরা জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আগে কিছুদিন ঢাকায় ছিলো আরিফ। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার পরে জ্বর হয়। প্রথমে স্থানীয়ভাবে জ্বরের ওষুধ সেবন করালেও কাজ হয়নি। পরে হাসপাতালে ভর্তি করে জানতে পারেন আরিফ ডেঙ্গু আক্রান্ত।

শুধু আরিফ এবং জাহিদুল নয়, হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১০ জন রোগীর সঙ্গে আলাপকালে তারা সবাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আগে ঢাকায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন। আর ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সবাই পুরুষ রোগী বলে জানা গেছে।

অপরদিকে, বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এখন পর্যন্ত ৬৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে।

বর্তমানে বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৩০ জন। তবে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর নিয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় এবং শেবাচিম হাসপাতালের তথ্যে মিল নেই। চলতি বছরে স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি মৃত্যু হয়েছে একজনের। আর শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে মৃত্যু হয়েছে দুই জনের।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় একসঙ্গে এতো রোগী আক্রান্তের বিষয়টি আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই এখনই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম, যাতে ঘরে বা আশেপাশে কোথাও সামান্য পানিও জমে না থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বলেন, গত বছরও এই সময় ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গিয়েছিল। এবারও বাড়বে বলে আমাদের শঙ্কা ছিলো। কেননা ঈদের আগেপরে অনেকেই বিভিন্ন প্রয়োজনে ঢাকা-বরিশাল আসা যাওয়া করেছেন। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হওয়ার আগে ঢাকায় ছিলেন।

বরিশালে এডিস মশা আছে কিনা, সম্প্রতি সময়ে এ নিয়ে কোন সার্ভে হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা সার্ভে করতে পারিনি। যখন দেখবো কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি আসছে, তখন সেই এলাকায় সার্ভে করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে মানুষ চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তির শিকার না হয়।

এদিকে, বর্ষা মৌসুম শুরুর সাথে সাথে বরিশাল নগরীতে মশক নিধন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে বলে দাবি নগরবাসীর। তারা বলছেন, অনেক দিন ধরেই সিটি করপোরেশন থেকে মশার ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে না।

তবে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তা রেজাউল করীম জানান, তাদের মশক নিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন ৪টি টিম হ্যান্ড স্প্রে এবং ১১টি ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধন করছে। এর মধ্যে হ্যান্ড স্প্রে দিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে। পাশাপাশি নগরীর ড্রেন এবং খালগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। ব্লিচিং পাউডার ছিঁটানো হচ্ছে, যাতে মশার বংশ বিস্তার না ঘটে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, এখন পর্যন্ত যারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন তারা কেউ সিটি করপোরেশন এলাকার না। আবার যারা সিটি এলাকার বাসিন্দা তারা ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে বরিশালে এসেছে। বরিশালে এডিস মশা নেই বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //