নদীভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে যমুনা পাড়ের মানুষ

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে যমুনা নদীতে পানি বাড়তে থাকায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, কাজিপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের তাণ্ডবে গত তিন সপ্তাহে এ চার উপজেলার অন্তত চার শতাধিক ঘর-বাড়ি, নানা সরকারি স্থাপনা, শত শত গাছপালা ও কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ও পাঁচিল গ্রামে, চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া, ঘোড়জান ও উমারপুর ইউনিয়নে এবং কাজিপুর উপজেলার কিছু অংশ।

যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে চৌহালী উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরনাকালিয়া, বিনানই, চরসলিমাবাদ, ঘোড়জান ইউনিয়নের ফুলহারা, মুরাদপুর, চরধীতপুর, উমারপুর ইউনিয়নের বাউশা, মিনিদা ও ধুবলিয়া গ্রামের নদীভাঙনে দিশেহারা হয়ে উঠেছে এসব গ্রামের বাসিন্দারা। এরই মধ্যে অনেকেই গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন টাঙিয়ে অতিকষ্টে বসবাস করছে। গত তিন সপ্তাহে চৌহালীতে দুই শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরসলিমাবাদ গ্রাম সংলগ্ন টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের ১৩১নং সলিমাবাদ পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবন সম্প্রতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ বিদ্যালয়টি নাগরপুর উপজেলার মধ্যে হলেও সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরসলিমাবাদ গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। স্কুলটি ভেঙে যাওয়ায় এসব কোমলমতি শিশুর পড়ালেখা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও অন্তত আরও ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে রয়েছে।


চর সলিমাবাদ গ্রামের বৃদ্ধ আব্দুল লতিফ জানান, ছোট থেকেই নদীভাঙন দেখছি কিন্তু আজও নদীভাঙন রোধ হয়নি। জমিজমা ঘর-বাড়ি হারিয়ে এখন নিঃস্ব। অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে কোনো মতে বসবাস করছি।

এদিকে কাজিপুর উপজেলার যমুনা নদীর মেঘাই ১ নম্বর সলিড স্পার এলাকায় অন্তত ৩০ মিটার এলাকা ধসে গেছে। বাঁধ পুরোপুরি ধসে গেলে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অপরদিকে যমুনায় পানি বাড়ার ফলে প্লাবিত হতে শুরু করেছে চরের নিম্নাঞ্চল। এতে তলিয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের ফসলি জমি।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে কাজিপুর উপজেলা রক্ষায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের প্রচেষ্টায় মেঘাই খেয়াঘাট এলাকায় ৩০০ মিটার স্পার নির্মাণ করা হয়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে স্পারটির মূল অংশের ১৫০ মিটার ধসে যায়। পরে স্পার মাটির অংশটুকু রক্ষায় সিসি ব্লক দিয়ে প্রটেকশন দেওয়া হয়। সম্প্রতি সেই স্পার বাঁধটির অংশের ৩০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে কাজিপুর থানা, খাদ্যগুদাম, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, কাজিপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। 

সম্প্রতি শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ও পাঁচিল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদী পাড়ের অসহায় মানুষজন অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকে আবার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য দ্রুত ঘর ও আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে পুরো এলাকায় ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভাঙন রোধে নদী পাড়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ভাঙন রোধে এসব জিও ব্যাগ কোনো কাজে আসছে না বলে জানান নদী পাড়ের মানুষ।

এনায়েতপুর স্পার বাঁধ থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদীর পাড় জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। এরপর টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে ২৬টি প্যাকেজে গত বছরের মার্চ মাস থেকে কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ধাপে ধাপে কাজ চলমান থাকলেও বেশি সময় কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে সাড়ে তিন বছরে যমুনা নদীর এই সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনের সময় ১০-১২ কোটি টাকার জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা হয়।

পাঁচিল গ্রামের নদী পাড়ের মানুষ জানান, গত পাঁচ বছরে নদীভাঙনে এই এলাকায় কয়েক লাখ বসতভিটা, হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে মাঝেমধ্যে অল্প সংখ্যক বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা কোনো কাজে আসেনি। এ বছরও বহু ঘর-বাড়ি ও আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে বহু ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদসহ নানা স্থাপনা।

ভিটেমাটি হারানো নদী পাড়ের মানুষের অভিযোগ, প্রায় এক বছর হলো কাজ শুরু হয়েছে নদী পাড়ে বাঁধ নির্মাণের। তবে বাস্তবে কাজের অগ্রগতি নেই। নদী পাড়ে ভরাট করে রাখা শত শত বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে, সেগুলোও পাড়ে ফেলতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে সঠিক সময় নদী পাড়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ না হওয়ায় এবারও যমুনার তীব্র ভাঙনে তাদের ভিটেমাটি হারাতে হচ্ছে। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব এসব মানুষ হয়ে পড়ছেন আশ্রয়হীন। নদীভাঙনের জন্য এসব এলাকার মানুষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। তাদের দাবি, সঠিক সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না করায় নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। 

শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল গ্রামের বাসিন্দা কোরবান আলী ও জহির হোসেন বলেন, গত কয়েক দিন ধরে যমুনার ভাঙনে আমাদের ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি নদীতে চলে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে প্রকল্পের ঠিকাদাররা অল্প কিছু সংখ্যক জিও ব্যাগ ফেলছে। আর তাছাড়া নদী পাড়ে স্তূপ করে রাখা প্রায় ৩০০ বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বছরের পর বছর দেখে আসছি ভাঙন শুরু হলে অল্প কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এসব কারণে ভাঙন রোধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ কোনো কাজে আসছে না।


কৈজুরি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুল লতিফ বলেন, গত ৩০ বছরের মধ্যেও আমরা এত ভাঙন দেখিনি। আমরা অন্য জায়গায় ঘর-বাড়ি করতে সক্ষম হলেও অনেক গরিব অসহায় পরিবার ভূমি ও গৃহহীন হয়ে পড়েছে। 

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মিলটন হোসেন বলেন, এনায়েতপুর স্পার বাঁধ থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল পর্যন্ত ৬৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদীর পাড় জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর পরপরই বন্যার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবারও বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। মালামালের দাম বৃদ্ধি ও ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে বাঁধ নির্মাণ কাজ কিছুটা পিছিয়েছে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরেক উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিত কুমার সরকার জানান, উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টির কারণে কয়েক দিন ধরেই যমুনার পানি বাড়ছে। এতে চরাঞ্চলের নিম্ন ভূমিগুলো প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে।

ভাঙনের সার্বিক বিষয় তুলে ধরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, পানি বৃদ্ধির ফলে চৌহালী, শাহজাদপুর ও কাজিপুর উপজেলার কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন রোধে চৌহালী উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে। কাজিপুরে স্পার বাঁধ ধসের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেখানেও বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ধস ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর স্পার বাঁধ থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদীর পাড় জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্প এলাকায় যে পরিমাণ বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা দরকার সে পরিমাণ বস্তা ফেলতে আরও অন্তত এক বছর সময় লাগবে। এক মৌসুমে তো আর এত বড় প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব না। আগামী জুন মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //