ঝিনাইদহে ড্রাগন চাষে বিপ্লব

ইউরোপিয়ান ফল ড্রাগন চাষে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে কৃষি প্রধান ঝিনাইদহে। ২ বছরের ব্যবধানে চাষ বেড়েছে ৮গুণ। জেলার ৮৪২ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে, যেখান থেকে উৎপাদন হয়েছে ৫৩৮ কোটি টাকার ফল। অথচ দুই বছর আগেও মাত্র ১৪১ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হতো।

সরেজমিনে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নের গৌরীনাথপুর গ্রামে যেয়ে দেখা যায়, এই ব্যতিক্রমী বাজারে শুধু ঝিনাইদহ নয় আশপাশের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন জেলার কৃষক এখানে ড্রাগনফল বিক্রি করতে আসে আর ব্যবসায়ীরা আসে ফল কিনতে। আর চুক্তিবদ্ধ শতাধিক কৃষকের ফল যাচ্ছে দুবাই।

গৌরীনাথপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খোরশেদ আলম জানান, গৌরীনাথপুরকে ড্রাগনের রাজধানী বলা হয়, এখানকার প্রতিটি পরিবার, কৃষক ড্রাগন চাষের সাথে জড়িত।


গৌরীনাথপুর ড্রাগন ফলের চাষি ও ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ড্রাগন ফলের ১টি মাত্র আড়ত গড়ে তোলেন।

এ অঞ্চলে হাজার হাজার টন মালাধারপুর গ্রামের কোটচাঁদপুর-মহেশপুর সড়কের গৌরীনাথপুর গ্রামেরাস্তার পাশে গড়ে তোলেন। তিনিই গৌরীনাথপুর ড্রাগন ফলের আড়ত তৈরির প্রথম উদ্যোক্তা। আড়তের নাম দেন ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আর ড্রাগনের রাজধানী গৌরীনাথপুর নতুন বাজার’। জসিম উদ্দিন বলেন, দেশের নানাপ্রান্ত ঘুরেছেন কিন্তু এত পরিমাণ ড্রাগন চাষ কোথাও দেখেননি। তাই আড়তের নাম দিয়ে দেন ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আর ড্রাগনের রাজধানী গৌরীনাথপুর’। এখন তার আড়ত থেকে প্রতিদিন ৪০-৫০ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হচ্ছে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসে পাইকার ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ী বিলাল হোসেন জানান, জসিমের দেখাদেখি একটার পর একটা আড়ত গড়ে উঠছে, যার সংখ্যা এখন ছোটবড় ২৮টি।

বাজারটি ঘুরে দেখা মেলে, জসিম উদ্দিনের সিয়াম-তাসিম ফল ভান্ডার, তারিকুল ইসলাম রিয়ালের নিলয়-নিগার এগ্রোফার্ম, নাজমুল হকের হক ফল ভান্ডার, আনিচুর রহমানের সরকার ফলভান্ডার, আবু সাইদ ও কামাল হোসেনের এসকে ফলভান্ডার, ইসমাইল হোসেন ও আসাদুলের আজিজ মিলিটারি মার্কেট, সাইদ,কামাল,সোহাগ ও জামিলের আয়ান ফলভান্ডার, কামরুল ইসলামের আলামপুর ফলভান্ডার, সোহাগ সরকারের বিসমিল্লাহ ফলভান্ডার অন্যতম।

আরো দেখা গেছে, পাইকার ব্যবসায়ীদের প্রতিটি আড়তে ১০-১৫জনের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে।

গৌরীনাথপুর গ্রামের একজন কলেজছাত্র মিন্টু, পড়া-লেখার পাশাপাশি তিনি ড্রাগনের আড়তে কাজ করছেন, এখানে ৪-৫ মাস আগে বাজার গড়ে ওঠায় তাদের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান।

কৃষক রুহুল আমিন জানান, শুধু শুধু শ্রমিক-কর্মচারী নয় ফলকে কেন্দ্র করে এখানে বাঁশ-খুঁটি, সিমেন্ট, রড, তার, নেট, সার-কীটনাশকসহ নানা পণ্যের কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। কৃষক, পাইকার ব্যবসায়ী, শ্রমিক-কর্মচারীদের হাকডাকে মুখোর হয়ে ওঠে গৌরীনাথপুর ড্রাগন ফলের বাজার। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে একটানা কেনা-বেচা। এরপর ট্রাক ট্রাক ড্রাগন ফল চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, চৌমহুনী, খুলনা, সিলেট, গাজিপুর, কাওরান বাজারসহ দেশের বড় বড় সব বাজারে যাচ্ছে গৌরীনাথপুর বাজারের ড্রাগন ফল।

স্থানীয়রা জানায়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, মেহেরপুরসহ নানা জেলার মানুষের নজর এই বাজারে। সপ্তাহের ৭দিন ধরেই কেনা-বেচার ড্রাগন ফলের এই পাইকার বাজারে দেড়শ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে ফল বিক্রি হচ্ছে। এক একটি আড়তে তরতাজা-সতেজ ৪ থেকে ৫টন ড্রাগন ফল সংগ্রহ করা হয়, যার দামপ্রায় ১০ লাখ টাকা। এভাবে ২০টি আড়তে প্রতিদিন ২ কোটি টাকার অন্তত ১০০ টন ড্রাগন কেনা-বেচা হচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানাপ্রান্তে।

ঢাকার আব্দুল্লাপুর সুইস গেট এলাকা থেকে এসেছেন পাইকার ব্যবসায়ী জামাল হোসেন খান। তিনি জানান, বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে এত বড় বাজার আগে কখনো দেখেননি।


কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরে মাঠের পর মাঠ শুধুই ড্রাগন ফলের চাষ। ঝিনাইদহের ১০০ চাষি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন দুবাইয়ে ফল রপ্তানিতে। তার দেখাদেখি অনেক চাষি ড্রাগন বাগান করছে।

তারা আরো জানায়, ঝিনাইদহ জেলায় ৮৪২ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের চাষ হচ্ছে। আর এ অঞ্চলে প্রতি হেক্টর জমি থেকে গড়ে ৩২ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জেলায় ২৬ হাজার ৯৪৪ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে। টাকার হিসাবে ২০০ টাকা কেজি দরে ১টন ড্রাগন ফলের দাম ২ লাখ টাকা। আর উৎপাদিত ২৬ হাজার ৯৪৪ টন ড্রাগন ফলের বাজারমূল্য ৫৩৮ কোটি টাকার উপরে। কৃষি অফিসের তথ্য থেকে আরো জানা গেছে, ঝিনাইদহে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৬ টন বা ৬৬ হাজার কেজি, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ হাজার টন বা এক কোটি কেজিতে উন্নীত হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আজগর আলী জানান, ওয়ার্ল্ডব্যাঙ্কের সহায়তায় গৌরীনাথপুর ড্রাগন বাজারে টিনের সেড নির্মাণ সহ নানা সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। এখানকার কৃষকদের ড্রাগন ফল বিদেশে রপ্তানি করতে শতাধিক কৃষক হ্যাপী হাট নামে দুবাইয়ের একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে চূড়ান্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এরই মধ্যে ফলের ওজন এবং বিষমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। তারা প্রতি সপ্তাহে ২টন করে ড্রাগন ফল পাঠাবে দুবাইয়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //