স্বাধীনতার ৫২ বছর পর কক্সবাজারের সাথে সারাদেশে রেলযোগাযোগ স্থাপিত

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত করতে আজ শনিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন চত্বরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের রেল চলাচলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর্যটন নগরী কক্সবাজারবাসীসহ সারাদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য এ দিনটি বড় আনন্দের।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান মন্ত্রী বলেন, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে সত্যি আমি খুব আনন্দিত। একটা কথা দিয়েছিলাম, কথাটা রাখলাম। আজকের দিনটি দেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন।

শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাদেশে অগ্নিসংযোগ করে মানুষের ঘড়বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানিরা। ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে দেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন জাতির পিতা।

 তিনি আরও বলেন, ক্ষমতার লোভে দেশের সম্পদ কারও হাতে তুলি দিতে রাজি নই। সরকারের উন্নয়নে গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশ। সড়ক যোগাযোগ ও মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে বর্তমান সরকার কাজ করছে। রেল সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিল। লাভ-লোকসানের হিসাব না করে এগিয়ে নেয় বর্তমান সরকার। 

 এর আগে বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া শেষে শিশুদের সঙ্গে ছবি তুলেন। এরপরই মঞ্চে উঠে বসেন।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হচ্ছে রেল। এটি সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত মেগা প্রকল্প। এর মাধ্যমে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র-সৈকতের শহরে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করা যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা আরও আশা করছেন, ট্রেন চালু হলে বদলে যাবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। এবছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক আসবে কক্সবাজারে। সেই সাথে বদলে যাবে কক্সবাজারের পাঁচ উপজেলা ও চট্টগ্রামের দুই উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রা। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। এছাড়া রেল লাইনকে কেন্দ্র করে পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে হবে হাজারো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান।

১৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত হয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্প। এর ফলে রেলওয়ে যুগে প্রবেশ করবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এর মাধ্যমে দেশের পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন হবে। শনিবার উদ্বোধনের পর ১ ডিসেম্বর থেকে এই রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন থেকে উদ্বোধনী ট্রেনে উঠে এই রুটের ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন এবং রামু রেলওয়ে স্টেশন নেমে যাবেন। নতুন এই রেললাইনের ফলে চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত দ্রুত ও নির্বিঘ্নে ট্রেন চলাচল নিশ্চিত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পর্যটন নগরীর কক্সবাজারের সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচলের উদ্বোধনকে ঘিরে সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে পুরো কক্সবাজার জুড়ে সাজ সাজ রব। উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে কক্সবাজারবাসীর মাঝেও।

কক্সবাজার শহরের ঝিলংজায় ঝিনুকের আদলে তৈরি এশিয়ার সর্ববৃহৎ আইকনিক রেল স্টেশনকে সাজানো হয়েছে মনোরমভাবে। এখানে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে নতুন দুইটি ইঞ্জিনের সাথে ব্র্যান্ড নিউ ১৫ বগির কম্পোজিশনের একটি ট্রেন। গত বুধবার ১৯টি বগিসহ দুইটি ইঞ্জিনের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ট্রেনটি কক্সবাজার পৌঁছে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন থেকে এই ট্রেনে চড়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন বহুল প্রতীক্ষিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচলের।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ডিসেম্বরের ১ তারিখে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে। একটি আন্তঃনগর ট্রেন দিয়ে শুরু হবে। একটা মেইল ট্রেন দোহাজারী পর্যন্ত চলাচল করে সেটা পরবর্তীতে কক্সবাজার পর্যন্ত আসবে। তিনি বলেন, তবে মিয়ানমারের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন বিস্তার করা এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য থাকলেও প্রতিবেশী দেশটির দুর্বল রেল অবকাঠামের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। রেলমন্ত্রী বলেন, এ রেলপথ নির্মাণে রাজনৈতিক একটা প্রভাব পড়বে। নির্বাচনী যে অঙ্গীকার করেছিলাম সেটা পূরণে বলা যাবে আমরা পূরণ করেছি। এতে মানুষ উন্নয়নের যে ধারা তার সঙ্গে থাকবে বলে মনে করি।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগা প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মেগা প্রকল্পে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।

প্রকল্পে যা আছে : দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ১০২ কিমি রেলপথ নির্মাণ হয়েছে। রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা রয়েছে  ৯টি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা এলাকায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্টেশন। আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে অনন্য সুন্দর রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান। তিনি বলেন, এই স্টেশন হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।

রেল সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে আধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাতকানিয়া -লোহাগাড়ার চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় রেললাইন স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

মনোমুগ্ধকর আইকনিক রেলস্টেশন: প্রকল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কক্সবাজার জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর স্থাপিত দৃশ্যমান আইকনিক রেলস্টেশন এখন বিনোদন প্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারও দর্শনার্থী দূর থেকে ভিড় করছেন ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটি দেখার জন্য। এ স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা। যদিও এখনো গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছে। উদ্বোধনের পর বাকি ফ্লোরগুলোর কার্যক্রম আস্তে আস্তে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //