বরিশালের নতুন নগর পিতার কাঁধে শত কোটি টাকার ঋণের বোঝা

আর দুইদিন পরেই ১৪ নভেম্বর দায়িত্ব বুঝে নিবেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তার আগেই বরিশাল সিটির উন্নয়নে ৭৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ একনেকে অনুমোদনের মাধ্যমে চমক দেখিয়েছেন তিনি। এখন দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘নতুন বরিশাল’ বিনির্মাণে কাজ শুরু করবেন নতুন নগর পিতা।

তবে নগর উন্নয়নের পাশাপাশি দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশ কিছু সংকটের মুখোমুখি হতে পারেন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত। যে সমস্যাগুলো বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের দীর্ঘদিনের পুরানো সমস্যা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বকেয়া বিদ্যুৎ ও ঠিকাদারি বিল এবং কর্মচারীদের বকেয়া বেতন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, তিনটি খাতেই বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ঋনগ্রস্থ দুই শত কোটি টাকার বেশি। তবে এ দেনার দায় নবনির্বাচিত মেয়র নিবেন কি না তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। আবার দায় নিলেও দেনা পরিশোধে পড়তে পারেন চ্যালেঞ্জের মুখে।

তবে এসব প্রশ্নের উত্তর নবনির্বাচিত মেয়রের দায়িত্বগ্রহণের দিনে আসবে বলে আশাবাদী নাগরিকরা। তাছাড়া আজ দায়িত্বগ্রহণ নিয়ে নতুন নগর পিতার সংবাদ সম্মেলনেও এসব বিষয় উঠে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বহু বছরের পুরানো সদস্যা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল। এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন এবং বিদ্যুৎ বিভাগের দ্বন্দ্বে কয়েক দফা বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারেও থাকতে হয়েছে নগরবাসীকে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সড়ক বাতি এবং বিভিন্ন পাম্প হাউজসহ নগর ভবন সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির বিদ্যুৎ। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরেই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে উদাসীন সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। সে হিসেবে কোম্পানিটির বরিশাল নগরীর দুইটি বিক্রিয় ও বিতরণ কেন্দ্রের কাছে সিটি কর্পোরেশনের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ৬০ কোটির বেশি।

বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যায় প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন মেয়র থাকাকালীন সময়। কিন্তু ওইসময় বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়লেও নিয়মিত বিল পরিশোধ হয়নি। এমনকি পরবর্তী মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়েও নিয়মিত বিল পরিশোধ না হওয়ায় বকেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। যে সদ্য সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সময়ে বকেয়ার পরিমাণ ৬০ কোটি ছাড়িয়ে যায়।

পূর্বের দুই মেয়রের সময়ে না হলেও সদ্য সাবেক মেয়রের দায়িত্বকালিন বকেয়া ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এবং পরবর্তী চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি দুই দফা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর ফলে ওই সময় ছয়দিন অন্ধকারে ছিল গোটা নগরী। পরে কিস্তিতে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের শর্তে সংকট নিরসন হলেও বকেয়ার পরিমাণ আগের জায়গাতেই রয়েছে।

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানির বরিশাল বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন বলেন, শুধুমাত্র আমার ডিভিশনেই সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৩৫ কোটি টাকার ওপরে। আর আমাদের দুইটি বিভাগ মিলিয়ে বকেয়ার পরিমাণ ৬০ কোটির বেশি।

এই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি সময়ে সিটি কর্পোরেশন কিছু বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছে। কিন্তু তাতে বেশি একটা লাভ হয়নি। সারচার্জসহ বকেয়া সেই আগের জায়গাতেই রয়েছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো মেয়রই বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পুরোপুরিভাবে পরিশোধ করে যায়নি।

এদিকে, বিদ্যুৎ বিলের মতই ঠিকাদারি বিলের পাহাড় জমে আছে। আর জমে থাকা বিদ্যুৎ বিল সবই তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরন এবং আহসান হাবিব কামালের আমলের। যদিও গেলো মেয়রের সময়ে ঠিকাদারি বিল বেশিরভাগ পরিশোধিত বলে জানিয়েছেন নগর ভবনের হিসাব শাখার দায়িত্বশীল সূত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আড়াই শতাধিক। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাকী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো গত পাঁচ বছরে তাদের ঠিকাদারি সনদ এমনকি ট্রেড লাইসেন্সও নবায়ন করেনি। এর ফলে গত পাঁচ বছরে সিটি কর্পোরেশন রাজস্ব হারিয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

যদিও ঠিকাদারি এবং ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করার পেছনে ভিন্ন যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন ঠিকাদাররা। তাদের দাবি, গত পাঁচ বছরে তাদের বকেয়া বিলের একটি টাকাও পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি নির্ধারিত লাইসেন্সের বাইরে সাধারণ ঠিকাদারদের কোনো কাজ দেয়া হয়নি। এ কারণে লাইসেন্স নবায়নে আগ্রহ দেখাননি অনেকে। তবে নগর ভবনের একাধিক সূত্র বলছে, ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে বেশ কিছু ঠিকাদারের বিল আটকে দিয়েছে নগর ভবন কর্তৃপক্ষ।

সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার সরকারি ব্রজমোহন কলেজে ছাত্র সংসদের আদলে গঠিত ছাত্র কর্মপরিষদের সাবেক ভিপি মঈন তুষার বলেন, সিটি কর্পোরেশনে অসংখ্য ঠিকাদার রয়েছে তাদের ঠিকাদারি কাজের বিল আটকে আছে। সব মিলিয়ে বকেয়া বিলের পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়াবে। যেখানে আমার নিজেরই এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল পাওনা। সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের আমল থেকে ঠিকাদারি বিল বকেয়া থাকলেও গত পাঁচ বছরে একটি টাকাও বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি।

অপরদিকে, সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত ৫৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বকেয়া ১৯ মাসের। এর সাথে সিলেকশন গ্রেড, ইনক্রিমেন্ট এবং টাইম স্কেল বন্ধ রয়েছে চার বছরের অধিক সময় ধরে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সদ্য সাবেক মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ১১ মাস নিয়মিত বেতন-ভাতা পেলেও হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে ওএসসি এবং বরখাস্ত হওয়া অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আবার দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারানো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়াও পরিশোধ হয়নি। সব মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়ার পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা হবে বলে দাবি তাদের।

এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কাজের বিল না পাওয়া ঠিকাদাররা এখন তাকিয়ে আছেন নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের দিকে। তিনি বৃহৎ অংকের এ বকেয়া পরিশোধের দায়িত্ব নিবেন, না কি বকেয়ার হিসাব আরও দীর্ঘ হবে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তারা। আর এসব প্রশ্নের উত্তর নতুন নগর পিতার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই মিলবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //