৫২ বছর পর নিজ গ্রামে হারানো স্মৃতির সন্ধানে

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বংকিরা। এক সময় বাম রাজনৈতিক ও চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য ছিল এই গ্রামসহ আশপাশের এলাকা। এখন নেই চরমপন্থিদের দৌরাত্ম্য, চুরি-ডাকাতির ভয়। পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাট, চাষ পদ্ধতি উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামের মানুষের অর্থনীতির।

জানা যায়, এই গ্রামেই বসবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার ম্যাজিস্ট্রেট নিখিলেশ্বর বসুর। তিনি এই অঞ্চলের প্রথম গ্রাজুয়েট এবং এলএলবি ছিলেন। সবাই মেনে চলতেন তাকে। ব্যাপক জমি ও সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। বরিশালেও ছিল তার জমি ও সম্পত্তি। বংকিরায় বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছে ভরা ছিল নিখিলেশ্বর বসুর জমিতে। তার পরিত্যক্ত প্রাচীন বাড়ির ইট খুলে নিয়ে গিয়ে অনেকেই করেছেন বাড়ি। নিখিলেশ্বর বসুর জমিতে এই গ্রামে রয়েছে একটি বড় খেলার মাঠ। সেখানে তৈরি হয়েছে স্কুল। বর্তমানে তার সকল জমিই মানুষের দখলে। তার পরিবারের কেউই এখন এখানে থাকেন না। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তার শেষ বংশধরেরাও পাড়ি জমান ভারতে।

আরো জানা গেছে, নিখিলেশ্বর বসুর দুইজন স্ত্রী ছিলেন। দেশ ভাগের আগেই তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানেরা ভারতে চলে যান এবং তার সাথে আর যোগাযোগ রাখেননি। তার ২য় স্ত্রীর কোন সন্তান ছিল না। তার বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য বরিশাল থেকে তার কর্মচারী যোগেন্দ্রনাথ রায়কে নিয়ে আসেন। যোগেন্দ্রনাথ রায়ের ৪ ছেলে ও দুই মেয়ে। নিখিলেশ্বর বসু যোগেন্দ্রনাথ রায়ের সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি উইল করে দিয়ে যান। তারাই এদেশে নিখিলেশ্বর বসুর উত্তরাধিকার। ১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ শুরু হলে তারা সবাই ভারতে চলে যান। আর ফিরে আসেননি।

ঘুরতে আসা রবীন্দ্রনাথ রায় গৌতম জানান, যোগেন্দ্রনাথ রায়ের বড় ছেলে তিনি। যখন ভারতে চলে যান তখন তার বয়স ১৩ বছর। সেখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি করেছেন। অবসর গ্রহণ করেছেন। জীবনের শেষ বেলায় জন্মস্থানের স্মৃতি ডাক দিয়েছে তাকে। যোগেন্দ্রনাথ রায়ের ছেলে-মেয়েরা সপরিবারে ঘুরতে এসেছেন, দেখতে এসেছেন জন্মস্থান। ১৬ ডিসেম্বর শনিবার তারা গ্রাম ঘুরে দেখেন। গ্রাম ছাড়ার সময় সদা চঞ্চল কিশোর আজ বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভোলেননি গ্রামের মানুষের কথা, যেখানে তার নাড়ি পোতা রয়েছে।

তিনি জানান, এখানে এসে তিনি খোঁজেন বাল্যকালের বন্ধু আলী হায়দার জোয়রদার, আব্দুস সাত্তার, ডা. ফজলুর রহমান ও আব্দুল লতিফকে। দুপুরে তিনি পা রাখেন তাদের দেওয়া জমিতে প্রতিষ্ঠিত স্কুল বংকিরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

বংকিরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. খসরুল আলম জানান, স্কুলে পৌঁছালে জমিদাতা পরিবারের সদস্য রবীন্দ্রনাথ রায় গৌতম, তার স্ত্রী বিশাখা রায়, ভাই উত্তম রায়, বোন আরতি রায়, সোমা দাস ও ম্যাজিস্ট্রেট নিখিলেশ্বর বসুর স্বজন মৃদুল জোয়ারদারকে স্বাগত জানানো হয়। অনুষ্ঠানে স্কুল ও গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে স্কুলের জমিদাতা পরিবারকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ রায় গৌতম আরো জানান, আমার বাবা জমিদার নিখিলেশ্বর বসুর প্রজা ছিলেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন। সেই কারণে বরিশাল থেকে আমার বাবাকে নিয়ে এসে পালন করেন। তারপরে আমাদের কয়-ভাইবোনের জন্ম। আমাদের ছোটবেলা ও বেড়ে ওঠা বংকিরা গ্রামে। আমরা দেখেছি ছোটবেলায় এই অঞ্চলে চোর ডাকাত আর চরমপন্থিদের দৌরাত্ম। মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। রাস্তা-ঘাট ছিল না, মানুষের খুব অভাব ছিল। এতদিন বাদে দেশে এসে আমরা অভিভূত। গ্রামের জমিতে সারাবছরই পানি জমে থাকতো। ধান-পাট ছাড়া অন্যকোন চাষ হতো না। মানুষের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল কম। তখন চরম ধর্ম বিদ্বে ছিল।

তিনি বলেন, এদেশের সরকার সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রণোদনা দিচ্ছেন শুনে ভালো লাগলো। তিনি বলেন, একজন জমিদারকে নিরাপত্তার অভাবে এদেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল। তখন যে বাংলাদেশ ছিল এখনকার বাংলাদেশ দেখে আমরা অভিভূত। আমরা গ্রামে এসে মানুষের আতিথেয়তায় অভিভূত হয়েছি। আমার দাদু নিখিলেশ্বর বসু মারা গেলে তার মরদেহ তিনদিন পরে সৎকার করা হয়। তিনদিন পর্যন্ত বাড়িতে মানুষের ভিড় ছিল। মানুষ তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো।

তিনি বলেন, নিখিলেশ্বর বসুর জমি মানুষের দখলে রয়েছে। আমরা সেগুলো ফিরিয়ে নিতে চাই না। মানুষ সেই সম্পত্তিগুলো ব্যবহার করে বর্তমানে সুখে আছে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে আমরা এতেই খুশি। সবশেষে বলতে চাই আমরা হিন্দু-মুসলিম যা হই আমরা সবাই বাঙালি। আমার ইতিহাস-ঐতিহ্য এক, সংস্কৃতি এক। আমরা হিন্দু-মুসলিম সমতার যে অভাবে দেশ ত্যাগ করেছিলাম সেই অভাব আজ নেই বলেই মনে করছি। আমরা আবার ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসবো। সারাদেশ ভ্রমণ করবো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //