শিক্ষকের অভাবে বিকাশ হচ্ছে না গারো মাতৃভাষা

নৃ-জনগোষ্ঠির মাতৃভাষায় কেবল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই হবে না। নিজ ভাষার পাঠ্যপুস্তকগুলো যাতে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে, যাতে সঠিকভাবে পাঠদান করা হয়, তাহলেই কেবল নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু শেরপুর জেলার গারো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গারো ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর মতো শিক্ষকের অভাবে শিশুর শিক্ষা ও বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এজন্য নৃ-জনগোষ্ঠি বসবাসকারী এলাকাগুলোতে নিজ ভাষাভাষি শিক্ষকের অভাব দূর করতে হবে। যথাযথ শিক্ষক নিয়োগের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শেরপুরে গারো মাতৃভাষায় শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের নেতারা।

গতকাল শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) শেরপুরে শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ হারিয়াকোনা এলাকায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চ প্রাঙ্গণে এ মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে নাগরিক প্ল্যাটফরম জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটি ও শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডব্লুউএ) এ মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে।

শ্রীবরদী টিডাব্লুউএ এর সভাপতি কবি প্রাঞ্জল এম. সাংমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জনউদ্যোগ আহবায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, সিনিয়র সাংবাদিক সুশীল মালাকার, ব্যাপ্টিস্ট চার্চের পাস্টার এলিয় মৃ, মানবাধিকার সংগঠক শামীম হোসেন, আইপি ফেলো সুমন্ত বর্মণ, সিপিবি নেতা সোলায়মান আহমেদ, উন্নয়ন কর্মী সুজল সাংমা, বাগাছাস নেতা জীবন ম্রং, কোচ নেতা মিঠুন কোচ, নারী নেত্রী আইরীন পারভীন, শিক্ষক এসএম আবু হান্নান, সাংবাদিক রেজাউল করিম বকুল প্রমুখ।

কবি প্রাঞ্জল এম. সাংমা বলেন, এটা ঠিক যে বর্তমান সরকারের দুরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী নৃ-জনগোষ্ঠির নিজেদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রি-প্রাইমারী পর্যায়ে গারো সহ কয়েকটি নৃ-জাতিগোষ্ঠির নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পাঠদানও চলছে। কিন্তু যেসব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে, সেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে  নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্দেশ্য বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাংবাদিক রেজাউল করিম বকুল বলেন, স্থানীয় বাস্তবতায় দেখা যায়, শেরপুর জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বর্মণ, বানাই, ডালু ও হদি সহ ৭টি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠির বসবাস। তাদের মধ্যে গারো, কোচ, হাজং এবং ডালু জনগোষ্ঠির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে কোন ধরনের বর্ণমালা সংরক্ষিত না হওয়ায় মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। তবে গারো জনগোষ্ঠি রোমান হরফে গারো ভাষার বর্ণমালা চালু করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু গারো অধ্যুষিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের অভাবে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। 

আইপি ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, দেশে বসবাসকারী সকল নৃ-জাতিসত্তার ভাষা রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। যেসব নৃ-জনগোষ্ঠির ভাষা প্রচলিত আছে কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা নেই, তাদের বর্ণমালা উদ্ধার ও লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সকল নৃ-জনগোষ্ঠির নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। নৃ-জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত এলাকায় মাতৃভাষায় পাঠদানের উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

কোচ নেতা মিঠুন কোচ বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমতল ও পাহাড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫ টিরও অধিক নৃ-জনগোষ্ঠির বসবাস। প্রতিটি নৃ-জাতিসত্ত্বার নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। আমাদের কোচ ভাষাটিও লিখিত রূপ না থাকায় বর্ণমালা হারিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে কোনো জনগোষ্ঠির ভাষা হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠি তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে নিজস্ব ভাষার বিষয়টি যুক্ত। মাতৃভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথ সম্প্রসারিত করে।

জনউদ্যোগ আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠির সাংবিধানিক অধিকার। যেকোনো মূল্যে সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যে চেতনায় আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলি, একই চেতনায় বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার কথাও বলতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //