অপ্রাপ্ত বয়সেই ৩ বিয়ে, সংবাদ করায় সাংবাদিকের নামে মামলা

অপ্রাপ্ত এক ছেলের ৩ বিয়ের ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করায় রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে লালমনিরহাটের ৪ সাংবাদিকের নামে মামলার আবেদন করেছেন ওমর আলী নামে এক নিকাহ রেজিস্ট্রার।

কাজী ওমর আলী সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার এবং আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক।

মামলার শিকার সংবাদকর্মীরা হলেন, লালমনিরহাট প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব লিয়াকত আলী, জাতীয় দৈনিক আজকের বিজনেস বাংলাদেশ পত্রিকার লালমনিরহাট প্রতিনিধি আশরাফুল হক, এশিয়ান টিভি ও জবাবদিহি পত্রিকার নিয়ন দুলাল ও দৈনিক লাখকন্ঠের আব্দুর রাজ্জাক।

জানা গেছে, জেলার আদিতমারী উপজেলার গন্ধমরুয়া গ্রামের আউয়াল মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া দুই বছর আগে প্রায় ১৮ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন মোগলহাট ইউনিয়নের ভাটিবাড়ি গ্রামের ফজলু হকের কিশোরী মেয়ে ফারজানাকে। বর কণে দুইজনের বয়স কম থাকায় বিয়ে রেজিস্ট্রি হলেও নকল দেননি পার্শ্ববর্তী মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। বিয়ের এক মাসের মধ্যে তাদের সংসারে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। নকল না থাকায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি মেয়ের পরিবার। অবশেষে বিয়ের এক বছরের মাঝে একই নিকাহ রেজিস্টারের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। বিচ্ছেদের পরে একইভাবে দুর্গাপুর গ্রামের আমিনুল হকের মেয়ে স্থানীয় ছাবেরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী খাতুনকে (১৩) দ্বিতীয় বিয়ে করেন রাজু মিয়া। দ্বিতীয় বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন রুপালীর স্কুলের মৌলভী শিক্ষক মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার কাজী ওমর আলী। বর কণে দুজনে অপ্রাপ্ত হওয়ায় নকল দেননি কাজী ওমর আলী। সেই বিয়েতেও এক মাস পরে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠে। আবারও সমস্যায় পড়েন বর ও কণের পরিবার। নকল না দেওয়ায় কোন পক্ষই নিতে পারছিল না আইনি পদক্ষেপ।

অবশেষে বর রাজু মিয়া রুপালীকে বিয়ে করেছেন মর্মে লিখিত দিয়ে গত বছরের ২৪ নভেম্বর তাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটান। তবে এ বিচ্ছেদের নোটিশ ফেরত পাঠান রুপালীর পরিবার। রাজুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিয়ের নকল চেয়ে দফায় দফায় নিকাহ রেজিস্টার ওমর আলীর সাথে যোগাযোগ করেন রুপালীর পরিবার। এ দিকে রাজু পুনরায় প্রথম স্ত্রীকে আবার তৃতীয় বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান।

অতিরিক্ত ফি আদায় করে নাবালক ছেলের বাল্যবিয়ে দিয়ে নকল না দেওয়ায় আলোচনায় আসেন কাজী ওমর আলী। পরে ওই কাজী বিদ্যালয়ের নাবালিকা শিক্ষার্থীর বিয়ে দিয়ে বৈধ কাগজ না দেওয়ার প্রতারণার ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করে চার সংবাদকর্মী। এ সংক্রান্ত বিষয়ে নাবালিকার পরিবারের সদস্য, বিয়ের সাক্ষী ঘটকসহ সংশ্লিষ্টদের ভিডিও সাক্ষাতকার এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

এদিকে সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা রেজিস্টার লিখিত কৈফিয়ত তলব করে ওই মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিটার কাজী ওমর আলীকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৫ জানুয়ারি চার সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করেন কাজী ওমর আলী। বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করতে লালমনিরহাট সদর থানাকে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।

অভিযুক্ত সাংবাদিকরা জানান, বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীর পরিবার বিয়ের নকল না পেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন এমন অভিযোগে ভিক্টিম, তার পরিবার ও বিয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের ভিডিও সাক্ষাৎকার ও প্রমাণ সংগ্রহ করে  প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের জন্য মিথ্যে মামলার আবেদন করেছেন নিকাহ রেজিস্টার। আইনিভাবে এ মামালা মোকাবেলা করা হবে বলেও তারা জানান।

লালমনিরহাট সদর থানা ওসি ওমর ফারুক বলেন, আদালতের নির্দেশে অভিযোগটি তদন্ত চলছে। তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

এ ব্যাপারে মামলার বাদী, মোগলহাট ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার ও  বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক কাজী ওমর আলী বলেন, রাজুর আগের বিয়ে এবং তার বিচ্ছেদও আমার মাধ্যমে হয়েছে। তবে রুপালীর সাথে রাজুর দ্বিতীয় বিয়ে আমি রেজিস্ট্রি করিনি।

বর-কণে অপ্রাপ্ত থাকলেও বাল্যবিয়ে কিভাবে দিলেন- এমন প্রশ্নের কোন জবাব দেননি তিনি।

তবে রাজুর দ্বিতীয় স্ত্রী রুপালী বলেন, আমার স্কুলের মৌলভী স্যার ওমর আলী আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন এবং বিয়ে পড়িয়েছেন। কিন্তু নকল দিচ্ছেন না।

জেলা রেজিস্টার খালিদ বিন আসাদ বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে প্রায় সমাবেশ করা হচ্ছে। মেয়ের ১৮ এবং ছেলের ২১ বছরের আগে বিয়ে আইনত অপরাধ। বাল্যবিয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তসহ অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

উল্লেখ, ৭ বছর আগে লালমনিরহাটকে বাল্যবিয়ে মুক্ত জেলা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণা কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ। কমেনি বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে ঠিকাতে গিয়ে হামলার শিকারও হচ্ছেন অনেক সমাজকর্মী। যার অভিযোগ দায়ের করেও কোন সুফল মিলছে না।

মোগলহাট ইউনিয়নের ওই নিকাহ রেজিস্টার স্কুল শিক্ষক ওমর আলী এর আগে হাতেনাতে বাল্যবিয়ে রেজিস্টির দৃশ্য দেখে তাকে নিষেধ করে জেলা রেজিস্ট্রার। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ বাল্যবিয়ের দায়ে কাজী ওমর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

সম্প্রতি বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গিয়ে জেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়ন নিকাহ রেজিস্টারের সহকারী রফিকুল ইসলামের হামলার শিকার হয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম। প্রতিকার চেয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জেলা রেজিস্টার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //