মির্জা শহিদুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:১৯ পিএম
আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৫২ পিএম
ভাষা সংগ্রামে অমলিন চরিত্র সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে জন্ম নেওয়া ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সঙ্গে যে নামগুলো জড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে জীবনবাজি রেখে রাজপথে মিছিল-মিটিং, লড়াই-সংগ্রাম করেছেন অকুতোভয় এই ভাষা সৈনিক। ভাষা সংগ্রামে অসামান্য অবদানের জন্য ‘ভাষা মতিন’ হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং এই ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ প্রতিটি দুরন্ত সংগ্রামে অংশ নেন আব্দুল মতিন। ভাষা মতিন ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও তার স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তার জন্মভূমি চৌহালী। ভাষা মতিনের নামে নেই কোন স্থাপনা। এমনকি তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার গ্রামের বাড়িতে একটি শহিদ মিনারও নির্মাণ হয়নি এতদিনেও।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার উমারপুর ইউনিয়নের ধুবুলিয়া গ্রামে মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। ডাক নাম ছিল গেদু। পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে তিনি ভাষা মতিন নামে পরিচিত লাভ করেন। বাবার কর্মজীবনের সুবাদে এই কিংবদন্তীর শৈশব কেটেছে পার্শ্ববর্তী ভারতের দার্জিলিংয়ে। সেখানে স্কুল জীবন শেষ করে ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আব্দুল মতিন।
ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস বলছে, ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নস্যাৎ করতে ঢাকায় সমাবেশ, মিছিল ও সভার ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এ ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না, এ নিয়ে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ওইদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আলোচনা হয়। উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন ও গাজীউল হকের নেতৃত্বে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন কমরেড আব্দুল মতিন। পঞ্চাশের দশকে আব্দুল মতিনকে ‘ভাষা মতিন’ বলে ডাকা শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখক বদরুদ্দীন উমর, বশীর আল-হেলালসহ আবুল কাসেম ফজলুল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, কে জি মুস্তফা তাদের লেখায় ‘ভাষা মতিন’ ব্যবহার করেন। ভাষাসংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব, মাহবুব আনাম, আবদুল গফুর, হাসান ইকবাল, এম আর আখতার মুকুল, কে জি মুস্তফা, আলাউদ্দিন আল আজাদও ‘ভাষা মতিন’ সম্বোধন করেন। যার কারণে সবার কাছে তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন।
এলাকাবাসী জানান, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সারা বিশ্ব যখন ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নানা আয়োজনে ব্যস্ত থাকে তখন ভাষা মতিনের জন্মভূমি সিরাজগঞ্জের চৌহালীর মানুষ শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে না; কলাগাছ দিয়ে অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করে সেখানে ভাষা শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয় তাদের।
এলাকাবাসী আরো জানান, ভাষা মতিন স্মরণে একটি পাঠাগার নির্মাণ করে দেয় একটি বেসরকারি সংস্থা। সেই পাঠাগারও নদী ভাঙ্গনের কবলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভাষা মতিনের সমবয়সি এক ব্যক্তি জানালেন, শৈশব-কৈশোরে ভাষা মতিনকে দেখলেও তার অবর্তমানে তাকে আর দেখতে পান না তারা। ভাষা মতিনের স্মরণে কোন স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা নির্মাণশৈলী না থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও অচেনা হয়ে যাচ্ছেন এই মহান যোদ্ধা। ভাষা মতিনের স্মৃতি ধরে রাখতে অন্তত একটি শহিদ মিনার কিংবা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান তিনি। ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের স্মৃতি স্মরণে একটি স্কুল ও কলেজ নির্মাণের দাবি জানান ভাষা মতিনের ভাই গোলাম আজম নান্নু।
তিনি বলেন, এই ভাষা যোদ্ধার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে একদিকে তার নাম যেমন অম্লান থাকবে স্থানীয়দের কাছে। একইভাবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে শিক্ষার আলো দেখবে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের মানুষ। একই সুরে কথা বলেন উমারপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মন্ডলও। তিনিও ভাষা মতিনের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি জানান।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান জানালেন, পাঠাগারটি শীঘ্রই পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা নেবে উপজেলা প্রশাসন। ভাষা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িতদের স্মৃতি ধরে রাখতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি। বায়ান্নোর ৮ ফাল্গুন, আমাদের চিরচেনা ২১ ফেব্রুয়ারি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এই ভাষা মতিনদের জন্যই। সেই রক্ত রঞ্জিত সংগ্রামের জন্য আজ আলোকিত হয়ে আছে আমাদের বাংলা ভাষা। বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সেই সঙ্গে পৌঁছে গেছে এই আন্দোলনের অগ্রনায়ক ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের নামও। কিন্তু তার গ্রামের বাড়িতে তার স্মৃতি রক্ষায় ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে পারলেই স্থানীয়দের কাছেও অম্লান থাকবে এই মহা নায়কের নাম। আব্দুল মতিন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করে গেছেন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh